ছিলো নদীবন্দর: কলারোয়ার চান্দুড়িয়ায় স্থলবন্দর চালুর দাবি
ছিলো নদীবন্দর, এখন স্থলবন্দর চালু সময়ের দাবি
সম্ভাবনাময় কলারোয়ার ঐতিহাসিক চান্দুড়িয়া
মো. আরিফ মাহমুদ
এমনই একটি সীমান্ত স্থান যেখানে একই সাথে স্থল সীমানা আবার নদী বা পানি সীমানা। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার চন্দনপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এক ঐতিহাসিক জনপদের চান্দুড়িয়া ও গোয়ালপাড়া গ্রাম। বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তভেদকারী ইছামতি নদীর কোল ঘেষে এই গ্রাম দু’টি। এ গ্রামের নামকরণের সঠিক ও প্রকৃত ইতিহাস জানা না গেলেও প্রবীনদের কাছে জনশ্রুতি আছে যে, চান্দু নামক প্রভাবশালী এক গোয়ালা (ঘোষ)সহ কয়েক ঘর গোয়ালা এই গ্রামে বসবাস করতেন। চান্দুর স্ত্রীর নাম ছিলো রিয়া। চান্দু ও তার স্ত্রীর রিয়ার নাম একত্রিত করে প্রথমে এই গ্রামের নাম হয় চান্দুরিয়া, পরবর্তীতে অঞ্চলটি চান্দুরিয়া থেকে চান্দুড়িয়া নামে পরিচিতি লাভ করে। চান্দুড়িয়ার দক্ষিণ অংশে অধিকাংশ গোয়ালাদের বসবাস ছিলো। গোয়ালাদের আধিক্যতার কারণে স্থানটি গোয়ালপাড়া নামে অভিহিত। চান্দুড়িয়া-গোয়ালপাড়া একটি গ্রাম হলেও বর্তমানে জনসংখ্যা আর ঘরবাড়ির আধিক্যতায় কার্যত দু’টি গ্রামে রূপ নিয়েছে।
ইছমতি বিধৌত বিভিন্ন তরুরাজির অপরূপ সবুজ শ্যামলীময় নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবিশিষ্ট জনপদ চান্দুড়িয়া। কলারোয়া উপজেলার মধ্যে ইতিহাসে-ঐতিহ্যে ঐতিহ্যবাহী এক নন্দিত, উন্নত ও সমৃদ্ধ জনপদ চান্দুড়িয়া। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। চান্দুড়িয়ার অতীত-বর্তমান অত্যন্ত ঐতিহ্যমন্ডিত ও গৌরবময় আর ভবিষ্যতও সম্ভাবনাময়।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক প্রফেসর মো.আবু নসর কর্তৃক লেখা ‘কলারোয়া উপজেলার ইতিহাস’ নামের বই থেকে পাওয়া যায়- বৃটিশ শাসন আমলে ইছামতি নদীর তীরে চান্দুড়িয়া একটি উল্লেখযোগ্য নদী বন্দর ছিলো। ইছমতি নদীর পূর্ব পাশে চান্দুড়িয়ায় চিনিকল, বৃহৎ গুড়ের হাট, পাইকরী কাপড়ের হাট ছিলো। রমরমা বাঁশের ব্যবসার জন্য ইছমতি নদীতে সারি সারি নৌকা বাঁধার ঘাট প্রভৃতি আজো চান্দুড়িয়ার পূরাকীর্তির নিদর্শন বহন করে। উত্তাল ইছমতি নদী যৌবন হারিয়ে আজ ছোট হয়ে গেলেও হারানো সেই অতীত এখন গৌরবময় ঐতিহ্যের স্বাক্ষর। বর্তমানে চান্দুড়িয়া ও ইছামতি নদীর পশ্চিমপাশে ভারতের কালাঞ্চি, গোপালপুর ও গর্জলা গ্রাম অবস্থিত।
বর্তমানে ইছামতি নদী সংলগ্ন দুই শ্রেণির আকর্ষণীয় মনোমুগ্ধকর নদী ও স্থল সীমান্ত তথা বর্ডার বিদ্যমান চান্দুড়িয়া-গোয়ালপাড়ায়। অর্থাৎ ওই স্থানে একই সাথে বিরাট এলাকাজুড়ে পানি ও স্থল সীমানা রয়েছে বাংলাদেশের সাথে ভারতের। যা পর্যটকসহ স্থানীয়দের বিশেষভাবে বিমোহিত করে।
চান্দুড়িয়ার গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে চান্দুড়িয়া বিজিবি বিওপির সামনে একজন জবরদস্ত দরবেশের দরগাঁ মোহাম্মদ শাহ ওরফে মল্লিক শাহের দরগাঁ ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন একটি মন্দির ছিলো। যেটার অংশ বিশেষ এখনো দৃশ্যমান। এছাড়া বৃটিশ ভারতের গোয়ালপাড়া দক্ষিণপাড়ায় (মাঠ পাড়া নামে পরিচিত) ঐতিহাসিক প্রাচীন জামে মসজিদ ছিলো, যেটা এখন সংষ্কার করে নতুন করা হয়েছে। বৃটিশ রাজত্বে অবিভক্ত বাংলায় এতদ্বাঞ্চলের একমাত্র চান্দুড়িয়া-গোয়ালপাড়ার দক্ষিণপাড়ার (বর্তমানে মাঠপাড়া) ওই জামে মসজিদে বর্তমানে ভারতের গোবরা, গোবিন্দপুর, তরনীপুরসহ ৪/৫টি গ্রামের ও বাংলাদশের কয়েকটি গ্রামের মুসল্লিরা শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করতেন বলে জানা যায়। এছাড়া বর্তমানে চান্দুড়িয়ায় মাঝেরপাড়া জামে মসজিদ, চান্দুড়িয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, কালের স্বাক্ষী ঈদগাঁহ, স্বনামখ্যাত বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, দৃষ্টিনন্দন চান্দুড়িয়া বিওপি বিদ্যমান।
প্রাচীন নদী বন্দরের সেই চান্দুড়িয়ায় আজো সম্ভাবনার চাঁদ উঁকি দেয়। কিছু উদ্যোগ সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে। প্রয়োজন শুধু সঠিক নেতৃত্ব আর বাস্তবসম্মত প্রচেষ্টা। যেমন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের দপ্তর স্থাপন, বাংলাদেশ-ভারতের পাসপোর্টধারী ও অধিবাসীদের যাতায়াতের জন্য কাস্টমস-ইমিগ্রেশন অফিস স্থাপনসহ চান্দুড়িয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর গড়ে তুলতে পারলে উন্নয়নের সম্ভাবনাময় স্বর্ণদূয়ার পরিলক্ষিত হতে পারে। স্থলবন্দরের পাশপাশি একই সাথে সেখানে ছোটছোট নৌযান দিয়েও আমদানি-রপ্তানি করা যেতে পারে। হতে পারে চান্দুড়িয়া বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনীতির তারকাস্থান। কেননা চান্দুড়িয়া-গোয়ালপাড়া এমনই একটি জনপদ যেখানে স্থল ও নদী পথ দু’টি দিক দিয়ে একই স্থানে মিলিত হয়ে গুরুত্ববহন করছে।
এছাড়া অবিভক্ত বাংলায় পারিবারিক ও রক্তের আত্মীয়-স্বজন পাশাপাশি অঞ্চলে বসবাস করলেও বিভক্ত বাংলায় মাঝখান দিয়ে বর্ডার হয়ে যাওয়ায় সেই পারিবারিক আর রক্তের আত্মীয়তা অনেকটা বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে যাতায়াতে। বর্তমানে অনেকে চুরি করে বর্ডার পার হয়ে আত্মীয়তার বন্ধন টিকিয়ে রেখেছেন মাঝেমধ্যে, অনেকে পাসপোর্ট-ভিসায় কয়েক বছর অন্তর অন্তর যাতায়াত করেন। আবার বর্ডারের বাঁধায় অনেকের রক্তের বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক আগেই। অন্যদিকে দুই দেশেই রাস্তাঘাটের চলমান উন্নয়নে চান্দুড়িয়া-গোয়ালপাড়ায় স্থলবন্দন স্থাপন করা গেলে দুই দেশের মানুষের অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আত্মীয়তার বন্ধনে নতুনত্ব পাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক এগিয়ে যাবে। অবৈধ অনুপ্রবেশ আর চোরাচালানী অনেকাংশে কমে যাবে। দুই দেশের মানুষের যাতায়াতে দুই দেশের অর্থনীতির চাকা চাঙ্গা হবে। পর্যটন শিল্প সৃষ্টি ও তরান্বিত হবে। দুই দেশই রাজস্ব ও ট্যাক্স পাবে। বহু সম্ভাবনা দেখা দেবে। সবমিলিয়ে চান্দুড়িয়া-গোয়ালপাড়া হতে পারে এ অঞ্চলের এক স্বপ্নপূরী। এমনটাই দাবি করছেন স্থানীয় অনেকেই। এছাড়া চান্দুড়িয়া ও পাশ্বর্বতী এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্যপট পিকনিক স্পট, বিনোদন স্পটসহ পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াচ্ছে বলেও অনেক মনে করছেন।
পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে হয়-
‘সুফলা বাংলায় পশ্চিম সীমায় ইছামতির আকে বাঁকে,
সেথা চান্দুড়িয়ায় তরুলতার ছায়ায় হাতছানি দিয়ে ডাকে।’
লেখক:
মো. আরিফ মাহমুদ
কলেজ শিক্ষক ও সাংবাদিক।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
০১৭১১৪৪৩১৬৪।
ছবিতে..
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)