বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
নির্বাচন ব্যবস্থা, দুদক ও সংবিধান সংস্কার নিয়ে যা বললেন কমিশন প্রধানরা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। সেই প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সংস্কারে ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত কমিশনগুলোতে যাদের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে তাদের প্রায় সবাইকেই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর নানা ইস্যুতে আগে থেকেই সরব দেখা গেছে। যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। ফলে তাদের কর্মপরিধি ও প্রক্রিয়া কী হবে তাও এখনো স্পষ্ট নয়। তবে, সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তারা।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশনের প্রধান হিসেবে যাদের দায়িত্ব দেয়ার কথা বলেছেন তারা হলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার দায়িত্বে বদিউল আলম মজুমদার; পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বে সফর রাজ হোসেন; বিচার বিভাগের দায়িত্বে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান; দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্বে ইফতেখারুজ্জামান; জনপ্রশাসনের দায়িত্বে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধানের দায়িত্বে শাহদীন মালিক।
কমিশন প্রধানরা অক্টোবরের প্রথমদিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবেন।
নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক
বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ঘুরেফিরে এসেছে বিভিন্ন অভিযোগ। নির্বাচনের আয়োজক নির্বাচন কমিশনগুলোর ভূমিকা নিয়েও তাই সমালোচনা আছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। এবার সেই নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হলো তাকেই।
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোনোদিনই সম্ভব নয়। এটা ইউটোপিয়ান (কাল্পনিক)। কিন্তু, সবার মতামতের ভিত্তিতে একটা কনসেনসাস(মতৈক্য) যদি দাঁড় করানো যায়, সেটিই হবে কাঙ্ক্ষিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের সম্মতির শাসন যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে যত ক্ষেত্রে যত সংস্কারই করা হোক না কেন, কোনোটাই টেকসই হবে না।’
দুদক সংস্কার হবে কীভাবে?
গণতন্ত্রের মতই সুশাসনের সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই তলানিতে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি বেড়েছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। বার্লিন-ভিত্তিক সংস্থাটি ২০২৩ সালে দুর্নীতির যে ধারণাসূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ নিচে নেমে গেছে বাংলাদেশ।
সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন দশম।
দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ইফতেখারুজ্জামানকে মনোনীত করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে।
দুর্নীতির ব্যাপকতার কথা উল্লেখ করে বিবিসি বাংলাকে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেহেতু দুদকের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, প্রথমে কমিশনের নিজস্ব আইন এবং এর সাথে যে সম্পূরক আইনগুলো আছে সেদিকে নজর দিতে হবে। আইনগুলো রিভিউ করে দেখতে হবে এগুলোতে কোথায় প্রতিবন্ধকতা আছে বা কোথায় সুযোগ আছে
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে দুর্বলতা ও ঘাটতি আছে; তাছাড়া, নেতৃত্ব, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, পেশাগত উৎকর্ষ নিয়েও ভাবতে হবে।’
দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধুমাত্র দুদককে সংস্কার করলে হবে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতিবাচক দিক এবং দুদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন বলেও মনে করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক।’
উদাহরণ হিসেবে অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ টেনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ড, সিআইডি, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট(বিএফআইইউ) এর মত প্রতিষ্ঠানে সংস্কার এনে সক্ষমতা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেই চেষ্টাও রাখতে হবে।
সংবিধান নিয়ে ভাবনা কী?
সংস্কারের যেসব দাবি উঠছে সেগুলোর অন্যতম সংবিধানের সংস্কার। এই সংস্কারের জন্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। কারণ বাংলাদেশে সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত শাহদীন মালিক।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হলেও তার কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। তবে, গত সপ্তাহেই বিবিসি বাংলার সঙ্গে এই ইস্যুতে কথা বলেছেন শাহদীন মালিক।
যেখানে মি. মালিক বলেন, ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে যা যা দরকার তা বর্তমান সংবিধানেই আছে। বিদ্যমান সংবিধান দিয়েই চাইলেই সংকটের সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশের সংবিধানে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ আছে। এখন অনেকে সংস্কারের কথা বলে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এই সংবিধানের যে ধারাগুলো আছে সেটাতে আসলে অসুবিধা কোথায় সেটা তো জানতে হবে।’
তিনি আরও বলে, ‘ওনারা যেইটা চিন্তা ভাবনা করবেন, সেটার আলোকেই কাজ করবো। সরকার ও আন্দোলনকারীদের সাথে আলাপ করে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সুপারিশ প্রস্তুত করা হবে।’
জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগের কী হবে?
পুলিশ বাহিনীতে অনিয়ম, দুর্নীতি, দলীয়করণের অভিযোগ যেমন আছে তাদের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও কম নয়। জুলাই-অগাস্টের ঘটনা পরম্পরায় এক পর্যায়ে রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়ে পুলিশি কার্যক্রম। এই সংকট থেকে বেড় হওয়ার জন্য দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে সাবেক জনপ্রশাসন সচিব সফর রাজ হোসেনকে।
সরকারের পক্ষ থেকে কাজের যে পরিধি নির্ধারণ করে দেয়া হবে তার ভিত্তিতে কাজ করতে চান বলে জানিয়েছেন সফর রাজ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘ওনারা যেইটা চিন্তা ভাবনা করবেন, সেটার আলোকেই কাজ করবো। সরকার ও আন্দোলনকারীদের সাথে আলাপ করে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সুপারিশ প্রস্তুত করা হবে।’
এছাড়াও বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেতে যাওয়া আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি কোন মন্তব্য করতে সম্মত হননি।
আর, বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য মনোনীত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে বুধবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কমিশনগুলোর কাজ তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। –
বিবিসি বাংলা
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)