সোমবার, জানুয়ারি ২০, ২০২৫

কলারোয়া নিউজ

প্রধান ম্যেনু

সাতক্ষীরা, দেশ ও বিশ্বের সকল সংবাদ, সবার আগে

৩০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলা

৩০০বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাতক্ষীরার ‘গুড়পুকুরের মেলা’। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ শে ভাদ্র ‘শ্রীশ্রীমনসা দেবী’র পূজা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ‘গুড়পুকুরের মেলা’। এই ‘গুড়পুকুরের মেলা’ গ্রামবাংলার লোকজ সংষ্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যই এখনও পর্যন্ত সাতক্ষীরার সংস্কৃতির মূলধারাটি বহন করে চলেছে।

লৌকিক আচার আচরণ, বিশ্বাস আর পৌরাণিকতায় সমৃদ্ধ সাতক্ষীরা জেলা। নানা কিংবদন্তির প্রবাহধারায় সজীব এখানকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বঙ্গোপসাগরের আঁচল ছোঁয়া ‘সুন্দরী সুন্দরবন’, আর সুন্দরবনকে বুকে নিয়ে সমৃদ্ধ এখানকার প্রকৃতি, এমনকি অর্থনীতিও। সুন্দরবনের চোখ জুড়ানো চিত্রল হরিণ, বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার (ডোরাকাটা বাঘ), বানর, কুমির, শুকর, অজগর, চোখ জুড়ানো নানা রঙের পাখি, বনমোরগ, সুন্দুরী গাছ, পশুর গাছ, বাইন গাছ, গড়ান গাছ, হেতাল গাছসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি থেকে শুরু করে নদ-নদী-খাল, বনবিবি বা বনদেবী, মোঘলীয় পুরাকীর্তি, অসংখ্য প্রতœত্ত¡নিদর্শণ, বারো ভূঁইয়ার অন্যতম রাজা প্রতাবাদিত্যের রাজধানী, সতীর একান্নখÐের একাংশ শ্রীশ্রী যশোরেশ্বরী মন্দির, শাহী মসজিদ, ১৬ হাত মানুষের কবর, জাহাজঘাটা, মাইচাম্পার দরগাহ, ৩শ বছরের পুরাতন মায়ের বাড়ির পঞ্চমন্দির, বিভিন্ন পুরাকালের কাহিনী, জারী-সারী, ভাটিয়ালি, পালাগান, পালকী গান এসবের মধ্যেই সাতক্ষীরার মানুষের আত্মীক পরিচয় গ্রন্থিত।

এখানে জন্মেছেন দেশ বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, কণ্ঠশিল্পী, চিত্রকর, জন্মেছেন জীবন সংগ্রামে ঋদ্ধ সংগ্রামী মানুষ। শোষণ-নিপীড়ণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর আত্মত্যাগী বীর। তিঁতুমীরের বাঁশের কেল্লার হয়ে যেমন লড়েছেন, তেমনি মহান ভাষা আন্দোলনে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধেও বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

গ্রামবাংলার লোকজ ইতিহাস ও ঐতিহ্যই এখনও পর্যন্ত সাতক্ষীরার সংস্কৃতির মূলধারাটি বহন করে চলেছে। খুব সহজেই এখানে মিলিত হয়েছে লৌকিক আচার-আচরণের সাথে পৌরাণিতত্তে¡র। যেন দুটো নদীর সম্মিলিত এক বেগবান ¯্রােতধারা। বছরের প্রায় প্রতিটি সময় ধরে অগণিত মেলা বসে সাতক্ষীরায়।

সুন্দরবনের সাগরদ্বীপ দুবলা চর থেকে শুরু করে খুলনা, যশোর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিং, বিক্রমপুর, ফরিদপুর এমনকি একসময় পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন জেলায়ও এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। সাতক্ষীরায় জেলার শুধু নয় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় লোকজ সংষ্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরা মেলাটি বসে সাতক্ষীরা শহরেই। পলাশপোলে গুড় পুকুরের পাড়ে “গুড়পুকুর মেলা”।

মেলাটির উৎপত্তি খুঁজতে নব্বইয়ের দশকে সাতক্ষীরার বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব মরহুম সোবহান খান চৌধুরির (৮০) পূর্বে নেয়া বক্তব্য ও পৌরাণিক ইতিহাসে কথিত আছে, সাতক্ষীরার জমিদার বংশীয় পূর্বপুরুষদের জনৈক ব্যক্তিত্ব ফাজেল চৌধুরী পলাশপোল এলাকায় খাজনা আদায় করে ফিরছিলেন।

অনেক পথ হেঁটে ক্লান্ত অবস্থায় শেষ ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে পলাশপোল গৌরদের পুকুর পাড়ের বটগাছ তলায় বটের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য বসলেন। বটের ছায়ায় বসতে না বসতেই ঘুম এসে গেল ফাজেল চৌধুরীর, শেকড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। বট গাছের ছায়ায় গাছতলায় ঘুম। তখন বটগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তীব্র কিরণ এসে পড়ল ফাজেল চৌধুরীর মুখে। রৌদ্র্যের তাপে ঘুম ভেঙে যেতে লাগলো ফাজেল চৌধুরীর। অস্বস্থি বোধ করলেন তিনি। সেই সময় বট গাছের মগডালে ছিল এক পদ্মগোখরো সাপ, সে তা লক্ষ করল। আস্তে আস্তে পদ্মগোখরোটি নেমে এলো নিচে। যে পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে ফাজেল চৌধুরীর মুখে পড়েছে, ঠিক সেখানে ফণা তুলে দাঁড়ালো পদ্মগোখরোটি। ফণার ছায়া এসে পড়ল ফাজেল চৌধুরীর মুখে। তিনি আরাম পেয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লেন।

কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার পর আবার ঘুম ভেঙে গেল। এর মধ্যে ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়েছে ফাজেল চৌধুরীর। চোখ মেলে বটের পাতার দিকে তাকালেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন একটি পদ্মগোখরো সাপ ফণা তুলে সূর্য কিরণকে আড়াল করে আছে। এবার ফণাটি একটু নড়ে উঠলো, দুলে উঠলো গাছের পাতা। ফণা নামিয়ে সাপটি হারিয়ে গেল ডালে ডালে পাতায় পাতায়। আবার সূর্যরশ্মি এসে পড়ল ফাজেল চৌধুরীর মুখে।

তখন তাঁর চোখে ঘুমের রেশ মাত্র নেই। শরীরে নেই একবিন্দু ক্লান্তি। ফাজেল চৌধুরী বটতলা ত্যাগ করলেন এবং এলাকার সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ডেকে বললেন, এখানে তোমরা মনসা দেবীর পূজা দাও। সেদিন ছিল ভাদ্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ শে ভাদ্র। ১২শ’ বঙ্গাব্দের গোড়ার দিকের কোন এক বছর। তখন থেকেই সাতক্ষীরা শহরের প্রাণ কেন্দ্র পলাশপোল গ্রামের সেই বটবৃক্ষের তলায় প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ শে ভাদ্র “শ্রীশ্রী মা মনসা দেবী”র পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

গুড়পুকুর পাড়ের দক্ষিণে বটগাছতলায় শুরু হয় ‘শ্রীশ্রীমনসা দেবীর পূজা’। আর ৩১ শে ভাদ্র শ্রীশ্রীমনসা দেবীর পূজা উপলক্ষে মেলা বসে। এই মেলার নাম হয় ‘গুড়পুকুর মেলা’। গুড়পুকুরের নামানুসারেই মেলার নামকরণ করা হয়েছে ‘গুড়পুকুরের মেলা’। মেলাটির বয়স অন্ততঃ ৩০০ বছর। এই ‘গুড়পুকুর মেলা’ নামকরণের পিছনে রয়েছে ইতিহাস ও কাহিনী।

সোবহান খান চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ ফাজেল খান চৌধুরীর আসল পরিচয়ে জানা যায়, সে আরও অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন বাংলাদেশে সুলতানী শাসন চলছে। বাংলার সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নতুন নতুন ধারার সূত্রপাত হচ্ছে। ক্রমশ: বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব। মুসলমান সমর নায়ক ও সৈনিকদের পাশাপাশি এদেশে আসতে শুরু করেছে পরিব্রাজক, সাধারণ কর্মচারী, ব্যবসায়ী, ভাগ্যান্বেষী ও সুফি-দরবেশ। সুফি দরবেশরা এসে ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করলেন।

সে সময় আরও অনেকের মত এদেশে আসেন উলুঘ খানে আজম খান জাহান (মৃত্যু: ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ)। খানজাহান আলী নামে পরিচিত। আনুমানিক বাংলা ৯ম শতকের দিকে তিনি বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। যা প্রাক মুঘল স্থাপত্যের এক অতুলনীয় নিদর্শন হিসেবে আজও বিদ্যমান। খানজাহান আলী ষাট গম্বুজ মসজিদে আবস্থান নিয়ে ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তখন তাঁর দুইজন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের খাজাঞ্চি ছিলেন। একজনের নাম শ্রী কামদেব রায় চৌধুরী, অন্যজন শ্রী জয়দেব রায় চৌধুরী।

একদা খানজাহান আলী রোজা থাকা অবস্থায় একটা কমলা লেবুর ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন, তখন ব্রাহ্মণদ্বয় বললেন, হুজুর আপনি তো আজ রোজা আছেন। এ অবস্থায় কমলা লেবুর ঘ্রাণ নিলেন, কথায় আছে, ঘ্রাণে অর্ধভোজন। খানজাহান আলী মৃদু হাসলেন, বললেন, তোমাদের সন্দেহ ঠিকই। আমার রোজার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। অন্য আর একদিন-খানজাহান আলী নিজেই রান্না করছিলেন।

ব্রাহ্মণদ্বয় সেখানে হঠাতই উপস্থিত হয়ে পড়লেন। বললেন, হুজুর আপনি নিশ্চয় মাংস রান্না করছেন? বড়ই সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। খানজাহান আলী আবারও মৃদু হাসলেন এবং বললেন, তোমরা তো গোমাংসের ঘ্রাণ নিয়ে ফেলেছো! এখন উপায় কি?

শ্রী কামদেব রায় চৌধুরী ও শ্রী জয়দেব রায় চৌধুরী চিন্তায় পড়লেন এবং কয়েকদিন পর খানজাহান আলী এর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। শ্রী কামদেব রায় চৌধুরী ও শ্রী জয়দেব রায় চৌধুরী যথাক্রমে কামাল উদ্দীন খান চৌধুরী ও জামাল উদ্দীন খান চৌধুরী হয়ে গেলেন। উল্লেখ্য যে, এই শ্রী কামদেব রায় চৌধুরী ও শ্রী জয়দেব রায় চৌধুরী-এর কথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাসেও বর্ণিত হয়েছে।
এ দুই জনের মধ্যে কোন একজনের পরবর্তী বংশধর বুড়া খাঁ বাগেরহাট থেকে এসে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল মৌজায় বাড়ি ঘর তৈরী করে বসবাস শুরু করেন। গড়ে তোলেন পলাশপোল চৌধুরী বাড়ি। চৌধুরী বাড়ির পূর্বপার্শ্বে একটা হোজর খানা (দরগা নামে পরিচিত) তৈরী করে সেখানে ধর্ম সাধনা করতে থাকেন। বুড়া খাঁ তাঁর বংশধরদের রেখে যান পলাশপোল চৌধুরী বাড়ি। চৌধুরী বাড়ির অধীনে তখন পলাশপোল মৌজার বৃহৎ এলাকা। এলাকাবাসী খাজনা দিতো চেীধুরীদের।

বর্তমান সাতক্ষীরা পৌর সভার সবচেয়ে বড় মৌজা পলাশপোল। এটাকে দুই ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। সেই বাংলা ১২ শতকের কোন এক সময় বুড়া খাঁর বংশধর ফাজেল চৌধুরী পলাশপোল এলাকায় খাজনা আদায় করে ফিরছিলেন। সে দিন ছিল ভাদ্র মাসের শেষ দিন। অর্থাৎ ৩১ ভাদ্র। পলাশপোল গুড়পুকুর পাড়ের বটগাছ তলায় বসেন বিশ্রাম নিতে। তখনই ঘটে উপরোক্ত শ্রীশ্রীমনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠানের ঘটনাটি। সেই থেকে শুরু হলো শ্রীশ্রীমনসা দেবীর পূজা ও পূজা উপলক্ষে মেলা। বর্তমানে ওখানে শ্রীশ্রী মা মনসা দেবীর পূজার সাথে বিশ্বকর্মার পূজাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

মেলার নাম “গুড়পুকুর মেলা”। বটগাছটার উত্তরে বিশাল দিঘি সদৃশ একটা পুকুর আছে। ওই পুকুরটার নাম ‘গুড়পুকুর’। তারই নামে মেলা। কিভাবে হলো এই নামকরণ? কথিত আছে, শ্রীশ্রী মা মনসা দেবীর পূজার উপলক্ষে প্রচুর পরিমাণ ভক্তদের আনা মিষ্টি বা বাতাসা ভোগ স্তুপে পরিণত হতো। ভক্তরা মিষ্টি বা বাতাসা প্রসাদ গ্রহণ করলেও আরও অধিক পরিমাণ মিষ্টি বা বাতাসা থেকে যেত। যা নেয়ার মানুষ পাওয়া যেত না। তখন ওই ভক্তদের আনা মিষ্টি বা বাতাসা ফেলা হতো শ্রীশ্রীমনসা বেদীর বটগাছের উত্তর পাশের ওই পুকুরে। ওই সময় ওই পুকুরের পানি মিষ্টি হয়ে যেত। এলাকার মানুষ তখন ওই পুকুরকে ‘গুড়পুকুর’ বলে ডাকতো। সেই থেকে ওই পুকুরের নামকরণ হয়ে যায় ‘গুড়পুকুর’।

সেদিনের গুড়পুকুরের মেলা অনেক বড় আকারে অনুষ্ঠিত হতো। সাতক্ষীরা শহরের প্রায় ৩ থেকে ৫ কি.মি. ব্যাপি গুড়পুকুরের মেলা বসতো। গুড়পুকুরের মেলা শুরু হবার অর্থাৎ ৩১ শে ভাদ্র শ্রীশ্রীমনসা পূজার সময় আসার দেড় ২ মাস আগ থেকে শুধু সাতক্ষীরা জেলা নয় দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে সাজ সাজ রব শুরু হয়ে যেত মেলার আয়োজন। বিশেষ করে খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহা, বাগেরহাট, নড়াইল, সাতক্ষীরার চারা-কলম, সবচেয়ে আকর্ষণ ছিল কাঠের তৈরী বিভিন্ন কাঠের তৈরী আসবাবপত্রের মধ্যে, কাঠের ফুলদানি, পুতুল, শো পিস সামগ্রী, কাঠের পিড়ি, দেলকো, বেলন, রুটি বেলা পিঁড়ি, বসার পিঁড়ি, আলনা, আলমারী, চেয়ার টেবিল, ওয়ারড্রব, শোকেস, ড্রেসিং টেবিল, খাট-পালঙ্ক প্রভৃিত।

কারুশিল্পী নজরুল ইসলামের মূল্যবান ও মনোরম কারুকার্য সম্পন্ন সেগুন কাঠের পালঙ্ক। যা প্রতিটি মনোরম কারুকার্য সম্পন্ন সেগুন কাঠের পালঙ্ক বিক্রি হতো লক্ষাধিক টাকায়। সেই পালঙ্ক এক নজর দেখার জন্য মানুষের ভিড় সামলানো কঠিন হতো।

ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ বিভিন্ন বিভাগ, জেলা, শহর, বন্দর, নগর ও গ্রাম থেকে আসতো মনোহারী সামগ্রী, মনোহরী দ্রব্যাদি, স্টেশনারি, শিশুতোষ খেলনার দোকানদাররা। শিশু ও কিশোরদের নানা রকমের খেলনা।

মনসা পুজা ৩১ ভাদ্র হলেও মেলা চলতো আশ্বিন মাসের প্রায় শেষ পর্যন্ত। লক্ষ মানুষের সমাগমে, হিন্দু মুসলিম জাতি ধর্ম বর্ণ নারী পুরুষ নির্বিশেষে এ এক মহামিলন স্থলে পরিণত হতো এই মেলা। মেয়েরা এই গুড়পুকুর মেলা উপলক্ষে বাবার বাড়িতে নাইয়োর আসতো। নাতি, নাতনি, মেয়ে জামাইয়ের মেলায় বেড়ানো ছিল এক বড় অনাবিল আনন্দময় ও উচ্ছ্বাসের।

এছাড়াও আসতো দেশীয় ফল মুল, আখ, বাতাবী লেবু, ইলিশ মাছ। মেলায় এসে আখ-ইলিশ-বাতাবি লেবু ছাড়া কেউ বাড়ি ফিরত না। ছিল বাঁশ ও বেত শিল্পের নানা দ্রব্য, ধামা, কুলা, ঝুড়ি, খাবার ঢাকনি, কর্মকারদের লৌহ শিল্পের দ্রব্যাদি, লোহার তৈরী দা, বটি, নারকেল কোড়ানি, কুড়াল, কাস্তে, খোন্তা, কোঁদাল, শাবলসহ প্রভৃতি। মোটকথা নিত্য ব্যবহার্য সবকিছুই মেলাতে ওঠতো।

বসতো অসংখ্য মিষ্টির দোকান। বাহারী ও রংবেরংয়ের মিষ্টির পসরা সাজিয়ে বসতো ময়রা দোকানীরা। দেশীয় তৈরী নানা রকমের খাবার, জিলাপী, ছানার সন্দেশ, খেঁজুর গাছের নলেন গুড়ের সন্দেশ ও জোড়া সন্দেশ, ছানার জিলাপী, বন্দে, মিহিদানা, গজা, রসমণি, রসগোল্লা, রসমালাই, সরপুরিয়া, ছানা, কদমা, বাতসা, মিষ্টিমুড়ি, ছোলা ভাজা, বাদাম ভাজা, চানাচুর, ঝুড়ি ভাজা, কত রকমের খাবার। ছিল মিষ্টি পানের হাজরো বাহারী আয়োজন। গুড়পুকুর মেলা উপলক্ষে দুই মাসাধিককাল শহরের মানুষের আর অন্য কোন ব্যস্ততা থাকতো না। প্রতিবছর মানুষ গুড়পুকুর মেলার জন্য অপেক্ষা করতো। আর দিন গুনতো কবে আসবে, ‘৩১ ভাদ্র’ কবে বসবে, ‘গুড়পুকুর মেলা’।

‘গুড়পুকুর মেলা’র বড় আকর্ষণ ছিলো, পুতুল নাচ, যাত্রা, নাগরদোলা, সার্কাস, সার্কাস খেলায় বাঘ, হরিণ, বানর, থাকত খাঁচায় ভরা। মৃত্যু কূপ বা মরণ কূপ, আসলাম খানের মটর সাইকেল চালনা। সিনেমা হলে এক টিকিটে দুটি শো। কি ছিল না! গুড়পুকুর মেলাকে ঘিরে সারা সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল, কামালনগর, ইটাগাছা, রসুলপুর, মুনজিতপুর, কাটিয়া, পুরাতন সাতক্ষীরা, আলীপুর, কদমতলা, বর্তমানের শহীদ কাজল সরণি, শহীদ নাজমুল সরণি, পাকাপোলের রাস্তা, মোটকথা সাতক্ষীরা শহরময় ছড়িয়ে থাকতো মেলা। সাতক্ষীরা শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত একসময়ের খরোস্রোত প্রাণসয়ের নদীতে নৌকায় করে আসতো মেলার সার্কাস, যাত্রা, পুতুল নাচ, কাঠ, চারা কললের পসরা ও জিনিসপত্র।

হাতি আসতো মেলার আরো আগে। এসেই শহর ঘুরে বেড়াতো আর জানান দিত, সার্কাস এসে গেছে। ছোটবেলায় উপভোগ করা মেলার এসব সময়ের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বর্তমান সাতক্ষীরার তরুণ সমাজ যা কল্পনাও করতে পারবে না। মেলা বিস্তৃত হয়েছিল দক্ষিণে আলীপুর পর্যন্ত আর উত্তরে কদমতলা-মাধবকাটি পর্যন্ত। আর পূর্ব দিকে পাটকেলঘাটা পর্যন্ত।

২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঘটে ৩শ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরা ‘গুড়পুকুর মেলা’র সর্বনাশাকাÐ। রাতে সাতক্ষীরার রক্সি সিনেমা হলে এবং স্টেডিয়ামে হঠাৎ বোমা হামলা হয়। তখন স্টেডিয়ামে চলছিল সার্কাস, দর্শকরা উপভোগ করছিলেন আনন্দে। হঠাৎ বোমা হামলায় সার্কাস লÐভÐ হয়ে যায়। চারিদিকে মানুষের ছুটাছুটি, কান্না ও ভয়াল দৃর্শ্য। এই বোমা হামলায় শিশুসহ মৃত্যুবরণ করেন ৩জন। বন্ধ হয়ে যায় তিন’শ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহি গুড়পুকুরের মেলা।

২০১০ সালে সাতক্ষীরার তৎকালীন জেলা প্রশাসক, কবি-সংস্কৃতজন মোঃ আব্দুস সামাদ সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন। গুড়পুকুরের মেলা আবার শুরু করেন তিনি। শুরু হলেও একে একে মেলা শ্রী হারিয়ে ফেলতে থাকে। স্থানাভাবে স্থান পরিবর্তন হয়। পলাশপোলের গুড়পুকুরের মেলা চলে যায় সাতক্ষীরা শহরের মধ্যে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে। ক্রমশঃ লোকজ ঐতিহ্যবাহি গুড়পুকুরের মেলা হয়ে ওঠে শহুরে মেলা। করোনার কারণে গতবছর মেলা হয়নি। এবছরও সময় চলে গেলো। মেলাটির ব্যবস্থাপনা করে থাকে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন আর পৌরসভা সম্মিলিতভাবে।

করোনার কারণে এবছরও মেলা হবে না বলে আজকের দর্পণকে জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, সাতক্ষীরার করোনা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। একারণে গতবছরের ন্যায় এবছরও গুড়পুকুরের মেলা অনুষ্ঠিত হবে না। করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে আগামী বছর গুড়পুকুরের মেলা অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরো বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে এবং আমি নিজে এই পূজায় উপস্থিত থাকবো।

একই রকম সংবাদ সমূহ

শহীদ জিয়া দেশের মানুষের জন্য বাতিঘর : সাবেক এমপি হাবিব

নিজস্ব প্রতিনিধি: বিএনপির প্রকাশনা সম্পাদক, সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিব বলেছেন,বিস্তারিত পড়ুন

শহীদ জিয়ার জন্মদিনে সাতক্ষীরা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের দোয়ানুষ্ঠান

ফিরোজ হোসেন: শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলেরবিস্তারিত পড়ুন

শহীদ জিয়ার জন্মবার্ষিকীতে সাতক্ষীরায় ছাত্রদলের দোয়া মাহফিল

ফিরোজ হোসেন, সাতক্ষীরা: বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শহীদ প্রেসিডেন্টে জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকীবিস্তারিত পড়ুন

  • সাতক্ষীরার বিভিন্ন সীমান্তে জব্দ করা বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধ্বংস
  • সাতক্ষীরায় শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি সভা
  • ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়ন বিএনপির কর্মী সমাবেশ
  • অসহায় ও ছিন্নমূল শীতার্ত মানুষের মাঝে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কম্বল বিতরণ
  • সাতক্ষীরায় কায়পুত্র সম্প্রদায়ের ভূমি সংক্রান্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
  • ঝাউডাঙ্গা বাজার কমিটির নির্বাচনকে ঘিরে তুমুল উদ্দীপনা
  • কলারোয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ
  • দেবহাটায় হিফজুল কুরআন ও ইসলামী সংগীত প্রতিযোগিতা
  • দেবহাটা পুলিশের অভিযানে মাদক ও সাজাপ্রাপ্ত ২ আসামী গ্রেফতার
  • ঝাউডাঙ্গায় জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সমাবেশ অনুষ্ঠিত
  • কলারোয়া পরিবেশক ব্যবসায়ী সমিতির কমিটি গঠন: সভাপতি শেখ সেলিম, সম্পাদক রবিউল
  • কলারোয়া সীমান্তে নারী-শিশুসহ আটক ৬, রুপিসহ ভারতীয় মোবাইল ফোন উদ্ধার