ইত্তেফাকের প্রতিবেদন
‘সমঝোতা’! বারবার জাপা প্রার্থীদের সরে দাড়ানোয় বিনা ভোটের নির্বাচন
‘সমঝোতা’। বারবার জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের সরে দাড়ানোয় দরকার পড়ছেন না ভোটের। ফলে বিনা ভোটে- বিনা নির্বাচনে নির্বাচিত হচ্ছেন শাসকদলীয় এমপি প্রার্থীরা।
এ যেনো নতুন এক খেলা শুরু হয়েছে। দেশের বেশ কয়েকটি সংসদীয় আসনে নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক জনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পথ তৈরি করে দিতে এই সমঝোতার খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন গোপনে। বিশেষ করে কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) ও ঢাকা-১৪ আসনের এবারের উপনির্বাচনে এই সমঝোতা ‘ওপেন সিক্রেট’।
এ দুটি আসনে বিএনপিবিহীন ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীরা দলের অগোচরেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের আংশিক) আসনের মতো একই খেলা হলো কুমিল্লা এবং ঢাকায়ও। পরপর তিনটি ঘটনাতেই জাপার প্রার্থীরা বিক্রি হয়ে গেছেন বলে খোদ দলটির নেতাকর্মীদেরই মুখে-মুখে চাউর।
এবার চারটি আসনের মধ্যে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে উপনির্বাচন হয়েছে গত সোমবার। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীকের প্রার্থী নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। উপনির্বাচনে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাপার ‘লাঙ্গল’ প্রতীকের শেখ মোহাম্মদ ফায়িজ উল্যাহ। এই আসনে জাপার প্রার্থী শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকলেও এখানেও ‘সমঝোতা’র চেষ্টা হয়েছিল।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ভোটের বেশ কিছুদিন আগে নয়ন একদিন সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে সরাসরি হাজির হয়েছিলেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে। কোনো রাখঢাক না করেই তার বনানীর কার্যালয়ে গিয়ে সমঝোতার নানা প্রস্তাব দেন নয়ন। তবে তার প্রস্তাবে সায় দেননি জি এম কাদের। একই দিন বনানী কার্যালয়ে জি এম কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের পর নয়ন তার প্রস্তাব নিয়ে কথা বলেছিলেন জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সঙ্গেও। বাবলুও তাকে তখন জানিয়ে দেন, এই পর্যায়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। কেন্দ্রের অনড় অবস্থানের কারণে ভোট থেকে সরতে পারেননি জাপার প্রার্থী ফায়িজ উল্যাহ।
ভোট থেকে সরে যাওয়ার জন্য দলের অনুমতি নিতে ফায়িজ উল্যাহর মতো ‘ভুল’ করেননি কুমিল্লা-৫ আসনে জাপার প্রার্থী মো. জসিম উদ্দিন ও ঢাকা-১৪ আসনে দলীয় প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক।
ফায়িজ উল্যাহর ঘটনা মাথায় রেখে দলকে কিছু না জানিয়েই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে ভোট থেকে সরে যান জসিম ও মোস্তাক। দলকে কিছু না জানিয়ে গোপনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় জসিমকে গত সোমবার দল থেকে বহিষ্কার করে জাপা।
অভিযোগ ওঠে, টাকার বিনিময়ে দলের অগোচরে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান জসিম। ফলে উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীকের প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবুল হাশেম খান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২৮ জুলাই কুমিল্লা-৫ ও ঢাকা-১৪ আসনে ভোটগ্রহণ হওয়ার কথা ছিলো, যদিও সেটার আর প্রয়োজন হবে না।
ঢাকা-১৪ আসনে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন চার জন। তারা হলেন—আওয়ামী লীগের আগা খান মিন্টু, জাপার মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক, জাসদের আবু হানিফ ও বিএনএফের কেওয়াইএম কামরুল ইসলাম।
তবে বুধবার মোস্তাকসহ অপর তিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন জমা দেন।
‘করোনার সময় নির্বাচন জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ’—এমন কারণ দেখিয়ে মোস্তাক, হানিফ ও কামরুল ভোট থেকে সরে যান। ফলে এখানেও আর ভোটের দরকার পড়ছে না।
ফল হিসেবে এখানেও আওয়ামী লীগের আগা খান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় কুমিল্লার জসিমের মতো দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তাককেও বৃহস্পতিবার দল থেকে বহিষ্কার করেছে জাপা।
জাপার কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, লক্ষ্মীপুরের ঘটনারই অনেকটা পুনরাবৃত্তি ঘটেছে কুমিল্লা ও ঢাকায়। লেনদেনের বিনিময়েই জসিম ও মোস্তাক দলের অনুমতি ছাড়া প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। কেন্দ্র বিষয়টি জানার পরেই দুই জনকে দল থেকে বাদ দিয়েছে।
এ বিষয়ে মোস্তাক বলেন, ‘প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগে আমি দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বলেছিলাম, ভোটের আগেই আমি ঘরে থাকতে পারছি না, নেতাকর্মীরা ঘরে থাকতে পারছেন না। আপনারা একটা সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে এটা জানান। কিন্তু চেয়ারম্যান ও মহাসচিব এতে রাজি হননি। তারা বলেছেন, ভোটে থাকতে হবে। এভাবে আমাদের প্রার্থী করে তারা বলির পাঁঠা বানাতে চান। তারা শুধু পারেন নির্বাচন কমিশনে গিয়ে একটা চিঠি দিতে, আর কিছু করতে পারেন না।’
মোস্তাক বলেন, ‘প্রার্থিতা প্রত্যাহারে আমার ওপর পারিবারিক চাপও ছিল। আমার বড় ভাই আর আগা খান একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। পরিবার থেকে বলা হচ্ছিল, আমি যেন তার বিরুদ্ধে ভোট না করি।’
অর্থ লেনদেনের অভিযোগের বিষয়ে মোস্তাক বলেন, ‘আমার সাথে তো আগা খানের দেখাই হয়নি। আর টাকার কথা যদি বলা হয় তাহলে বলব, দলে তো পদ-বাণিজ্য চলছে। কারা বাণিজ্য করছে, সেই তালিকা আমার কাছে আছে, প্রয়োজনে প্রকাশ করব।’
অর্থ লেনদেনের অভিযোগ সম্পর্কে কুমিল্লার জসিম উদ্দিন বলেছেন, ‘আমি কোনো টাকা নিইনি। আমি জমিদার পরিবারের সন্তান। আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখবে। আর হাশেম খান গরিব মানুষ। তবে আমাদের স্থানীয় নেতাকর্মীরা যখন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল, তখন একজন আমাদের নেতাকর্মীদের ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে যাতায়াত খরচ বাবদ, তা-ও তারা এই টাকা নিতে চায়নি।’
এর আগে একই রকম ঘটনা ঘটে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঐ আসনে জাপার প্রার্থী ছিলেন দশম সংসদের এমপি ও জাপা নেতা মোহাম্মদ নোমান। জাপার সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে এই আসনে দলীয় প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে ভোটের কয়েক দিন আগে হঠাৎ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাপার নোমান।
এতে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পথ সুগম হয় ‘আপেল’ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের। ‘১২ কোটি টাকার খেলা’য় নোমানের সেসময় ভোটের মাঠ থেকে সরে যাওয়ার ঘটনা দেশ জুড়ে আলোচিত হয়।
পরে অর্থ ও মানব পাচারের অপরাধে কুয়েতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন পাপুল। কুয়েতের আদালতে সাজা হওয়ায় এমপি পদ হারান তিনি। সোমবার পাপুলের আসনে উপনির্বাচন হয়। টাকার খেলায় ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণে নোমানকেও দল থেকে বহিষ্কার করেছিল জাপা।
অবশ্য আগামী ২৮ জুলাই অনুষ্ঠেয় সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনে জাপার প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)