থ্যালাসেমিয়া : প্রয়োজন সচেতনতা ও প্রতিরোধ
থ্যালাসেমিয়া কি?
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত মারাত্মক রক্তশূন্যতা যা শিশুরা পিতামাতার কাছ থেকে জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের লাল কণিকা পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় না। ফলে তারা মারাত্মক রক্তশূন্যতায় ভোগে। থ্যালাসেমিয়া রোগীরা আজীবন রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। এই রোগের চিকিৎসা যেমন দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল, তেমনি এটি মোকাবিলায় যথেষ্ট মানসিক শক্তি ও ধৈর্যের প্রয়োজন। তাই থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধেই এর প্রতিকার। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশই তরুণ অর্থাৎ, তাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তরুণরা থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতন হয়ে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করলে আগামী প্রজন্মের আমরা এর সুফল দেখতে পাবো।
থ্যালাসেমিয়া কেন হয়?
জীনগত সমস্যার কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। মানব দেহে রক্তের হিমোগেøাবিন ২ ধরনের প্রোটিন দ্বারা তৈরিঃ আলফা গ্লোবিন ও বিটা গ্লোবিন। জীনগত সমস্যার কারণে রক্তের হিমোগ্লোবিনের আলফা বা বিটা চেইন এর যে কোনোটি তৈরিতে সমস্যা হতে পারে । থ্যালাসেমিয়া তখনই হয় যখন এই ২টি প্রোটিন উৎপন্নে সাহায্যকারী জীনে কোন ত্রুটি দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়া দু ধরনের। একটি হচ্ছে আলফা থ্যালাসেমিয়া ও অন্যটি হচ্ছে বিটা থ্যালাসেমিয়া। আলফা থ্যালাসেমিয়া তখন দেখা দেয় যখন আলফা গ্লোবিন প্রোটিনের সাথে সম্পর্কিত জীন পরিবর্তিত থাকে অথবা অনুপস্থিত থাকে এবং যখন ত্রুটিপূর্ণ জীনগুলো বেটা গ্লোবিন প্রোটিন উৎপন্নে বাঁধা দেয় তখন বেটা থ্যালাসেমিয়া হয়। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যাই বেশি, অর্থাৎ বেশির ভাগ রোগীরই হিমোগ্লোবিনের বিটা চেইন তৈরিতে সমস্যা হয়। তবে হিমোগেøাবিনের কোনো নির্দিষ্ট চেইন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় দুটি জিনের মধ্যে একটিতে যদি কারও সমস্যা হয়, তাহলে এই রোগে আক্রান্ত হবেন না, কিন্তু তিনি এই রোগের একজন বাহক হবেন। এই রোগের বাহকদের সাধারণত তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। তবে একজন বাহক যদি পরবর্তীকালে অন্য একজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে তাঁদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ কি?
জীনগত সমস্যার কারণে হয় বলে, এ রোগ সাধারণত শৈশবেই দেখা দেয়। রক্তশূন্যতা, জন্ডিস, অরুচি, ফ্যাকাশে ভাব, দুর্বলতা, বারবার বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়া এবং শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে না হওয়া থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ। এসব রোগীর মুখের গড়নেও কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। সাধারণত যকৃৎ ও প্লীহা বড় হয়ে যায়। রক্তশূন্যতা খুব বেশি হলে হৃৎপিন্ড তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে এবং রোগীর শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য উপসর্গ হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া সনাক্ত করা যায় কিভাবে?
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কিনা তা নির্ণয় করা হয় ।
থ্যালাসেমিয়া সনাক্ত হলে কি চিকিৎসা নিতে হবে?
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি কোনো রোগী থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হন, তাহলে তাঁকে চিকিৎসা নিতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরাই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়, তাই তাদের চিকিৎসা হওয়া উচিত একজন শিশু রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত¡াবধানে। রোগীকে রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি অবশ্যই ‘আয়রন চিলেশন’ চিকিৎসাও নিতে হবে। তা না হলে রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে আয়রনের বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে রোগী মারা যান। ‘আয়রন চিলেশন’ চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে বাংলাদেশের অধিকাংশ রোগীই তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না, তাঁরা শুধু মাসে মাসে রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের চিকিৎসা সম্পন্ন করেন। ফলে এই রোগীদের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। এসব রোগীর আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার ব্যাপারে থাকে বিধিনিষেধ। আর আয়রনসমৃদ্ধ ওষুধ খাওয়া যাবে না একদমই।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার কারণে শারীরিক অন্যান্য জটিলতা কি?
বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে আর সেই সাথে মাঝারি থেকে প্রকট ধরনের থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসাও বর্তমানে সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু সব কিছুরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যে আছে তা মেনে নিতেই হবে।
১. হার্ট এবং লিভারের অসুখঃ নিয়মিত রক্ত সঞ্চালণ থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার একটি প্রধান উপায়। ফলে রক্তে আয়রন ওভারলোড হয়ে অর্গান এবং টিস্যুর ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশেষ করে হৃদপিন্ড ও যকৃত।
২. ইনফেকশনঃ থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের মৃত্যুর আরেকটি কারণ হল ইনফেকশন। বিশেষ করে যাদের প্লীহা শরীর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ ইনফেকশনের সাথে যুদ্ধরত অঙ্গটি আর শরীরে অবস্থান করছে না।
৩. অস্টিওপোরোসিসঃ যাদের থ্যালাসেমিয়া আছে তাদের মধ্যে হাড়ের সমস্যা যেমন অস্টিওপোরোসিস দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এটি এমন এক সমস্যা যার ফলে শরীরের হাড় ক্ষয় হয়ে ভঙ্গুর হয়ে যায়।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিকার ও প্রতিরোধ কি?
আসলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে রক্ত পরিসঞ্চালন ছাড়া তেমন কোন উপায় নেই এটি প্রতিকারের জন্য। তবে অবস্থার যেন আরও অবনতি না ঘটে সেটার জন্য দৈনন্দিন জীবনাচরণে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
১. আয়রন সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া বা অতিরিক্ত আয়রন গ্রহন না করাঃ আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহন করা যাবে না এবং অতিরিক্ত আয়রন গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। যতদিন না চিকিৎসক আপনাকে নির্দেশনা না দিবেন ততদিন আয়রন সমৃদ্ধ ভিটামিনও গ্রহণ করা যাবে না।
২. স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণঃ থ্যালাসেমিয়া হলে ফলিক এসিড আছে এমন খাদ্য গ্রহণ করা এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর এমন খাদ্য খাওয়া উচিত। এতে আপনার শক্তি ও পুষ্টি বজায় থাকবে। চিকিৎসকরা সাধারণত ফলিক এসিড গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, এতে আপনার শরীরে নতুন রক্ত কনিকা তৈরি হয়। এছাড়াও দেহের হাড়ের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি আর ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে।
৩. সংক্রমণ থেকে দূরে থাকুন ও টিকা নিনঃ নিজেকে সংক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য সব সময় সাবান দ্বারা হাত পরিষ্কার করুন ও ঘরের বাহিরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করুন । বিশেষ করে আপনার শরীর থেকে যদি প্লীহা কেটে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে এবং জ্বর সর্দি বা ছোঁয়াচে অসুখে অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকুন। মেনিনজাইটিস, হেপাটাইটিস বি এর টিকা গ্রহণ করুন সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য।
৪.গর্ভধারণের পূর্বে থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করাঃ গর্ভধারণের পূর্বে থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা তা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষ করা এবং যদি একজন মহিলা অথবা তার স্বামীর বংশে থ্যালাসেমিয়ার ইতিহাস থাকে তাহলে গর্ভধারণের আগে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। রক্ত পরীক্ষা আর ফ্যামিলি জেনেটিক পর্যবেক্ষণ করে জানা যাবে ২ জনের কেউ থ্যালাসেমিয়ার শিকার অথবা বাহক কিনা। সাধারণত থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে রোগের কোনো ধরনের লক্ষণ থাকে না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাহক যখন গর্ভাবস্থায় থাকেন, তখন তাঁর রক্তশূন্যতা হলে তা আয়রন, ফলিক অ্যাসিড বা অন্য কোনো ওষুধ সেবনের মাধ্যমে ভালো হয় না। এ ছাড়া বাহকের তেমন কোনো সমস্যাই হয় না।
৫.বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষাঃ যদিও এই পদ্ধতি আমাদের সমাজে এখনও প্রচলিত নয়, তবুও আমাদের উচিত নিজেদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বার্থে বিয়ের আগে হবু বর এবং বউয়ের রক্ত পরীক্ষা করা। যেন দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে না হয়। কারণ, দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে হলে তাঁদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
এজন্য, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে জনমনে এ সম্পর্কে শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তবে আশার কথা হল, গবেষকরা থ্যালাসেমিয়া প্রতিকারের জন্য গবেষণা করে যাচ্ছেন। খুব শিগ্রই হয়তো ষ্টীম সেল আর জীন থেরাপির মাধ্যমে এ রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্ভব হবে, ইনশা-অল্লাহ।
লেখক: ডাঃ মোঃ সাইফুল আলম, মেডিকেল অফিসার, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল, সাতক্ষীরা।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)