নড়াইলের বাইরে যেতে পারছে না লাঞ্ছিত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের তিন কন্যা
নড়াইলের বাইরে যেতে পারছে না লাঞ্ছিত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের তিন কন্যা। নড়াইলে নিরাপত্তার অভাবে বাইরে যেতে পারছে না লাঞ্ছিত অধ্যক্ষের তিন কন্যা। টিনশেড বাড়ি, চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। বেশ কয়েকবার ‘কেউ আছেন, কেউ আছেন’ বলে উচ্চস্বরে ডাকলেও বারবার বাড়ির ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। কেউ এগিয়ে আসেনি।
কিছুক্ষণ পর একজন বৃদ্ধা মহিলা কাছে এসে পরিচয় জানার পর বাড়ির ওঠানে বসতে দেন। এ বাড়িটিই হচ্ছে স্বপন কুমার বিশ্বাসের। যার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
যদিও সরেজমিন সদর উপজেলার সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের বড়কুলা গ্রামে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের এ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পুলিশ পাহারা বসেছে। তবে ১৮ জুনের ঘটনার পর থেকে আর বাড়িতে ফেরেননি ওই অধ্যক্ষ। তার স্বামী ও পরিবারের লোকজন নিরাপত্তাহীনতার ভুগছেন বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী।
নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে ওই কলেজে দর্শন বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত ১৭ জুন তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।
ওই দিন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় ওরফে বাপ্পী রায় নিজের ফেসবুক আইডিতে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে পোস্ট করেন- ‘প্রণাম নিও বস ‘নূপুর শর্মা’ জয় শ্রীরাম’। বিষয়টি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে কলেজের কিছু ছাত্র তাকে সেটি মুছে (ডিলিট) ফেলতে বলেন।
এরপর ১৮ জুন সকালে অভিযুক্ত ছাত্র কলেজে আসলে তার সহপাঠীসহ সব মুসলিম ছাত্র তার গ্রেফতার, দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি ও তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের দাবি তুলে অধ্যক্ষের নিকট বিচার দেয়। কিন্তু ওই সময় ‘অধ্যক্ষ একই সম্প্রদায়ের লোক হওয়ায় তাকে রক্ষা করার চেষ্টায় ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’ এমন কথা রটানো হলে উত্তেজনা তৈরি হয়। এ সময় উত্তেজিত জনতা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসেরও গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছিল।
অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের স্ত্রী সোনালী দাস বলেন, ‘আমার স্বামী ষড়যন্ত্রের শিকার, তিনি ওই কলেজে থাকুক তা অনেকে চায় না। ঘটনার সময় কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের জানিয়েছিলেন, আইসিকে (মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ) জানিয়েছিলেন এবং কলেজের অন্যান্য শিক্ষকসহ স্থানীয় অনেকের সবার সহযোগিতা চেয়েছিলেন আমার স্বামী (অধ্যক্ষ স্বপন কুমার)। এরপরও সবার উপস্থিতিতেই এত বড় ঘটনা ঘটল, তাকে অপমান অপদস্থ করা হলো।
তিনি আরও বলেন, তিনি কোথায় আছেন আমরা জানি না। ঘটনার পর থেকে তিনি আর বাড়ি ফেরেনি, তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, করাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তার কাছে কোনো মোবাইল ফোন নেই। অন্যের ফোন দিয়ে কয়েকবার সামান্য কথা হয়েছে। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। আমরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়েও ভয়ে আছি। আমার স্বামী এ ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত নয়। তাকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে।
একই প্রসঙ্গে স্বপন কুমার বিশ্বাসের মেয়ে শ্যামা রাণী বিশ্বাস বলেন, আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। বর্তমানে আমরা খুবই ভয়ে আছি। আমার বাবা এখন কোথায় আছে আমরা সঠিক জানি না। আমাদের তিন বোনেরই পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে। আমার মেজো (অধ্যক্ষের ২য় কন্যা) বোন এসএসসি পরীক্ষার্থী। সে প্রাইভেট পড়তে যেতে পারছে না। একই সঙ্গে ছোট বোনেরও পড়াশোনার সমস্যা হচ্ছে। আমার বাবার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। অন্যায় না করেও তিনি অপমান অপদস্থ হয়েছেন। আমাদের নিরাপত্তার অভাবে আমরা ঘরের বাইরে যেতে পারছি না।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের একটি আবেগঘন পোস্ট ভেসে বেড়াচ্ছে। এতে তিনি বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘৩০ বছর ধরে আমি এই কলেজে শিক্ষকতা করি। ছাত্ররা আমার প্রাণ, স্থানীয়রাও আমাকে ভালোবাসত। তবু আমার সঙ্গে যা ঘটে গেল, এরপর এই মুখ নিয়ে কী করে আমি কলেজে যাব।
ওই পোস্টে চূড়ান্ত হেনস্তার বর্ণনা দিয়ে স্বপন কুমার আরও বলেন, ‘পুলিশ আমাকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে শত শত পুলিশ ছিল। এর মধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল। আমাকে পুলিশ ভ্যানের কাছে নেওয়ার সময় পেছন থেকে অনেকেই আঘাত করেছে। আমি মাটিতে পড়ে যাওয়ায় পায়ের কিছু জায়গায় কেটে যায়। তখন অনুভব করি পেছন থেকে কেউ আমার মাথায় আঘাত করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, প্রকৃতপক্ষে মাসখানেক আগে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পাঁচজন কর্মচারী নিয়োগের চেষ্টা চালায় ওই কলেজের প্রভাবশালী একটি চক্র। এতে বাধা দেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। এরপর থেকেই চক্রটির তোপের মুখে আছেন তিনি।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)