করোনায় শিশু ও মায়ের প্রয়োজন ভিটামিন সি
ভিটামিন সি অতি প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান। এই ভিটামিন দেহের এমন কিছু প্রাণ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়, যার সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে। ভিটামিন সি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং বিভিন্ন রোগ ও সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সি এর গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান সময়ে করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশেষজ্ঞরা যেহেতু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন, সেহেতু ভিটামিন সি গ্রহণের গুরুত্ব আরো অনেক গুণ বেড়ে গেছে।
করোনা ভাইরাসের এই মহামারির সময় শিশু ও মায়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। সম্প্রতি চীনের জানজান ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল সাইন্স বিভাগের গবেষক জিয়া ও সেনমি মিনজি বলেছেন, করোনা প্রতিরোধে ভিটামিন সি বেশি করে খেতে হবে। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তাই শিশু ও মাসহ সব মানুষের প্রতিদিনই নিয়মিত ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিশু ও কিশোর-কিশোরীসহ বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের শরীর সুস্থ-সবল, সতেজ ও রোগমুক্ত বিশেষ করে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত করতে ভিটামিন সি এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন সির অভাবে দুর্বলতা, ওজন অত্যধিক কমে যাওয়া এবং স্কার্ভি নামক এক ধরণের রোগ হতে পারে। এ রোগে দাঁতের মাড়ি ফুলে যায়, দাঁতের গোড়া থেকে রক্তপাত হয় ও পুঁজ পড়ে। এতে মাড়িতে ব্যথা হয় এবং অকালে দাঁত পড়ে যায়। স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন সি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এজন্য একে অ্যান্টি এসকরবিউটিক ভিটামিনও বলা হয়ে থাকে। শিশু, কিশোর-কিশোরী, গর্ভবতী ও প্রসূতি মাতাসহ আমাদের দেহের অপুষ্টিজনিত রক্তশূন্যতা রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন সি এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ ভিটামিন সি শরীরে লৌহের শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়। যারা নিরামিষ খান, তারা যদি যথেষ্ট পরিমাণে ভিটাসিন সি গ্রহণ না করেন, তাহলে উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে শরীর লৌহ কণিকা শোষণ করতে পারে না। এছাড়া দাঁত, মাড়ি ও পেশী সুস্থ, সবল ও মজবুত রাখার জন্য ভিটামিন সি বিশেষ প্রয়োজন।
সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শরীরে ভিটামিন সি দরকার। কারণ শরীরের কোনো অংশে সংক্রমণ দেখা দিলে সেখানে রোগ প্রতিরোধী কোষ পাঠাতে সহায়তা করে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি নানা ধরনের ভাইরাস ইনফেকশন, সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ঠান্ডা থেকের্ ক্ষা করে এবং দেহে রোগ প্রতিরোধের যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এই ভিটামিন সর্দি বা ঠান্ডা থেকে নিউমোনিয়া বা ফুসফুসের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে। এটি দেহের ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকাতে সহায়তা করে। ভিটামিন সি পাকস্থলীর সুস্থতা রক্ষা করে এবং দেহের ত্বককে মসৃন ও উজ্জ্বল রাখে। বয়স বাড়লে মানুষ স্মৃতিভ্রম ও হাড়ের স্বাস্থ্যক্ষয়জনিত যেসব সমস্যায় ভোগে, তা ঠেকিয়ে রাখতে পারে।
জানা যায়, ভ্রুণের মানসিক বৃদ্ধিতে ভিটামিন সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ভিটামিন ফলিক এ্যাসিডকে কার্যকর করে তোলার চালিকা শক্তি। গর্ভের শিশুর মাংসপেশি ও হাড় গঠনের কোলাজেন প্রোটিনের প্রয়োজন। ভিটামিন সি কোলাজেন তৈরিতেও সাহায্য করে এবং শরীরের ভেতর ক্ষতিকর কিছুর প্রবেশে বাধাদানে সহায়তা করে। ভিটামিন সি ফ্যাগোসাইটের কার্যক্রমও বাড়াতে পারে। ফ্যাগোসাইট হচ্ছে ইমিউন কোষ যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য কণাকে গিলে ফেলতে পারে। এছাড়া ভিটামিন সি লিম্ফোসাইটের বৃদ্ধি ও বিস্তার বাড়াতে পারে।
লিম্ফোসাইট হচ্ছে এক প্রকারের ইমিউন কোষ, যা রক্তের বহিরাগত ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও বিষাক্ত পদার্থকে প্রতিহত করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। সেই সঙ্গে তা প্রোটিনের মাত্রাও বৃদ্ধি করে। তাই প্রতিদিনের খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি থাকা প্রয়োজন।
ভিটামিন সি চর্বি ও কোলেষ্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে দেহকে হৃদরোগ থেকের্ ক্ষা করে এবং বিভিন্ন প্রকারের চর্মরোগ ও ব্যথা-বেদনা নিরাময়ে সাহায্য করে। ভিটামিন সি একটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বা জারণ বিরোধী পদার্থ যা, কোষের সজীবতাকের্ ক্ষা করে বার্ধক্যজনিত লক্ষণ প্রকাশে বিলম্বিত করে। উচ্চ রক্তচাপ কমাতেও এই ভিটামিনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, শরীরে নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা বজায় রাখতে ভিটামিন সি সহায়তা করে। আর এই যৌগটিই রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে কমিয়ে দেয় রক্তচাপ। সুতরাং যারা মোটামুটি মাত্রার উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তারা রক্তচাপ কমাতে নির্ভাবনায় অতিরিক্ত ভিটামিন সি খেতে পারেন। ভিটামিন সি কিছু কিছু ক্যান্সারের আক্রমণ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভিটামিন সি গলনালী, মুখ গহবর ও পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। তাছাড়া স্বরযন্ত্র, অগ্নাশয়, মলাশয়, স্তন এমনকি ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধেও এই ভিটামিন যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। ভিটামিন সি জীবননাশক রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রেখে জীবনকে দীর্ঘায়িত করে দেয়। তাই ভিটামিন সি মানুষের জন্য দীর্ঘায়ুর এক প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান এবং পরম বন্ধু।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, একজন পূর্ণবয়ষ্ক পুরুষের জন্য দৈনিক ৯০ মিলিগ্রাম ও নারীর জন্য দৈনিক ৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন। মায়ের দুধে গরুর দুধ অপেক্ষা পাঁচগুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। সুতরাং স্তন্যদানকালে মায়ের খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি দেয়া দরকার। এজন্য প্রসূতি মায়েদের জন্য দৈনিক অতিরিক্ত ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি গ্রহণ করা দরকার। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের দৈনিক ২০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন। একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক লোক প্রতিদিন ৩/৪টি আমলকি বা মাঝারি আকারের একটি পেয়ারা কিংবা বড় আকারের ২টি আমড়া গ্রহণ করলেই তার শরীরের ভিটামিন সির চাহিদা পূরণ হয়। তবে দেহের প্রয়োজনীয় চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণে এই ভিটামিন গ্রহণ করা উচিত। এতে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদার অতিরিক্ত ভিটামিন সি গ্রহণ করলে গর্ভবতী, প্রসূতি মা ও দুগ্ধ গ্রহণকারী শিশুদের মাঝে স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করা যায়। তাছাড়া শিশুদের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণে বাড়তি খাদ্যের সাথে প্রতিদিন পাতিলেবু ও কাগজিলেবুর রস খাওয়ানো উচিত। যেসব শিশু ভাত খায় তাদের ভাতের সাথে লেবুর রস চেপে দিয়ে ভাত খাওয়ালে ভিটামিন সি এর চাহিদা অতি সহজেই পূরণ করা যায়। শিশুদের স্কার্ভি রোগের নিরাময়মূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিদিন শিশুকে চিনি মেশানো পানিতে পাতিলেবুর রস দিয়ে শরবত করে খাওয়ানো যেতে পারে।
টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল ভিটামিন সি এর উৎকৃষ্ট উৎস। এদেশের সস্তা ও সহজলভ্য ফলগুলোর মধ্যে আমলকি, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, আমড়া, কাগজিলেবু, পাতিলেবু, কামরাঙা, কুল, জলপাই, কালোজাম, আনারস, ঢেউয়া, পাকা পেঁপে ও আম থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। অথচ শুধু অজ্ঞতা ও পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে আমরা এসব দেশীয় সহজলভ্য ফলগুলোকে অবহেলা করে স্বল্প পুষ্টিযুক্ত বিদেশী দামি ফল যথা-আপেল, আঙুর ও কমলার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হই। আপেল, আঙুর ও কমলা দামি হলেও এদেশের আমলকি, পেয়ারা ও বাতাবিলেবু সহজলভ্য, দামে সস্তা অথচ ভিটামিন ‘সি’-তে ভরপুর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, প্রতি ১০০ গ্রাম আপেলে রয়েছে ৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি অথচ ১০০ গ্রাম আমলকিতে আছে ৪৬৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি। তেমনি কমলালেবুতে ৪০ মিলিগ্রাম, পেয়ারায় ২১০ মিলিগ্রাম, আঙ্গুরে ২৯ মিলিগ্রাম এবং বাতাবিলেবুতে ১০৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি রয়েছে। এছাড়া মূলাশাক, পালংশাক, ফুলকপি, লাউশাক, ডাঁটাশাক, কচুশাক, পুঁইশাক, লালশাক. কলমিশাক, সরিষাশাক, পুদিনা শাক, থানকুনি, কাঁচা মরিচ, সজিনা পাতা, ধনে পাতা, লেটুস, বাঁধাকপি, টমেটো এসব শাকসবজিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ভিটামিন সি এর চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ শাকসবজি ও ফলমূল থেকে পূরণ করে থাকে। ভিটামিন সি পানি, বাতাস ও তাপের সংস্পর্শে সহজে নষ্ট হয়ে যায় এবং এটি সহজেই পানিতে দ্রবণীয়। ফলমূল রান্না না করে সরাসরি কাঁচা খাওয়া যায় বলে এতে বিদ্যমান ভিটামিন সি এর সবটুকুই দেহের কাজে লাগে। কিন্তু শাকসবজি রান্না করে খেতে হয় বলে ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে নষ্ট হয়। শাক বা সবজি কেটে পানিতে ধোয়ার সময় ভিটামিন সি বেশি নষ্ট হয়। তাই শাক বা সবজি রান্নার আগে পরিষ্কার পানিতে ভাল করে ধুয়ে বড় বড় টুকরো করে কাটতে হবে। কাটা শাকসবজি পুনরায় ধোয়া বা পানিতে না রেখে সাথে সাথে রান্না করলে ৫৩-৭০% ভিটামিন সি অপচয় কম হয়। রান্নার সময় শাকসবজি যথাসম্ভব কম সিদ্ধ করতে হবে। এতে শাকসবজির পুষ্টিমান অধিক বজায় থাকে। রান্নার পর পরই তাড়াতাড়ি শাকসবজি খেয়ে ফেলতে হবে। টমেটো, শসা, গাজর, লেটুস, মুলা, ধনে পাতা এসব শাকসবজি পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে সালাদ হিসেবে খেলে এতে বিদ্যমান ভিটামিন সি পুরোপুরি শরীরের কাজে লাগে।
সংগ্রহ করার পর ফল ও সবজিতে বিদ্যমান ভিটামিন সি এর পরিমাণ অনবরত কমতে থাকে। তাই সংগ্রহের পর দেরি না করে এগুলো খেয়ে ফেলা উচিত। সর্বোপরি বয়স্ক নারী, পুরুষ, শিশু ও কিশোর-কিশোরী সব মানুষের দেহের প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কিছু কিছু টাটকা ও তাজা শাকসবজি এবং ফলমূলের ব্যবস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
মো. আবদুর রহমান
শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়), ফিচার প্রকল্প, পিআইডি।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)