সাতক্ষীরায় কালাম ও মারুফ হত্যার ১৪ বছর : বিচারের অপেক্ষায় পরিবার
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ
১১ বছর আগে ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারী স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পেটুয়া বাহিনীর সদস্যরা বুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে দেবহাটা উপজেলা শিবিরের সেক্রেটারী মেধাবী ছাত্র আবুল কালাম ও জামায়াক কমীর্ রায়হানকে। এ ঘটনার ১০ বছর পর ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি ৭ নম্বর আদালতে নিহত মারুফ হোসেনের ভাই মোঃ মোকফুর হাসান বাদী ভাই হত্যার বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাতক্ষীরা—৩ আসনের সাবেক এমপি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক এসপি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, তৎকালিন সহকারী পুলিশ সুপার ও সাবেক এসপি কাজী মনিরুজ্জামানসহ ৬২ জনকে এ মামলায় আসামী করা হয়। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় ডিআইজি খুলনাকে। ইত্যো মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা স্বাক্ষীদের জবান বন্দী গ্রহণ করেছে। কিন্তু অজ্ঞাগত কারণে মামলার তদন্ত রিপোর্ট এখনো আদালতের কাছে পৌছানি বলে বাদী পক্ষের আইনজীবি এড হাফিজুর রহমান জানান। আবুল কালাম ২০১০ সালের দাখিল পরীক্ষায় গোল্ডেন—এ প্লাস আর ২০১২ সালের আলিম পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়েছিল। বাবার বড় স্বপ্ন ছিল তাকে মানুষের মত মানুষ করার। কিন্তু তা আর হলো না। সন্তান হত্যার শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে মারা যান কালামের বাবা মা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীরা জানায়, দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা আবুল কালাম (১৭) ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারী শুক্রবার বিকেলে মায়ের সাথে দেখা করতে যায়। এসময় তার মা বলে, বাবা তুমি খেয়ে না খেয়ে থাকো। আজ যখন বাড়িতে এসেছো, তখন দু’টো ভাত খেয়ে যাও। এসময় কালাম বলে, মা পুলিশ আমাকে খুঁজছে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে। মা চোখ মুছতে মুছতে বলে, বাবাকে দু’টো ভাত খেতে সময় লাগবে না। ভাতের প্লেট সামনেও দিয়েছিল। কিন্তু এরমধ্যে বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে যৌথবাহিনী। তারা ঘরের ভেতরে ঢুকে তাকে ধরে কোন কিছু না বলেই কালো টুপি পরিয়ে গাড়িতে তোলে। এর আগে দুপুরে একই উপজেলার ইল্লারচরস্থ শ্বশুড়বাড়ি থেকে কুলিয়ার বাসিন্দা ক্বারী আশরাফুল আলমের ছেলে জামায়াতকর্মী মারুফ হোসেন ছোটনকে (২২) গ্রেফতার করে এবং মাথায় কালো টুপি পরিয়ে থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদেরকে শুক্রবার রাত শনিবার দিন ও দিবাগত রাতে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে অভিযান এবং তাদের উপর নির্যাতন চালায়। রোববার ভোর সোয়া ৫টার দিকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আবুল কালাম ও মারুফ হোসেনকে সখীপুর ইউনিয়নের নারিকেলি গ্রামে এনে দু’জনের বুকে গুলী করে। পরে পর পর আরও ৮/১০ রাউড গুলী করে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। তাদের এই গুলীর শব্দে এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে ভয়ে কেউ বাড়ি থেকে বের হয়নি। আবুল কালাম ও মারুফ হোসেনকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় যৌথবাহিনী প্রথমে সখীপুর হাসপাতাল পরে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে কালাম ও মারুফের গ্রেফতার খবর শনিবার অনেক মিডিয়াতে প্রচার ও প্রকাশিত হয়। এরপরও তাদেরকে থানায় আটকে রাখা হয় অজ্ঞাত কারণে আদালতে চালান দেয়া হয়নি। এনিয়ে তাদের পরিবার—পরিজন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ছিল। এরমধ্যে রোববার ভোর রাতে গুলীর শব্দ পেয়ে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ—খবর নিতে শুরু করে। একপর্যায়ে টিভিতে দ্যাখে সাতক্ষীরার দেবহাটায় আবুল কালাম ও মারুফ হোসেন নামের দু’জন যৌথবাহিনীর গুলীতে নিহত হয়েছে। পরবর্তীতে পুলিশের কাছে খবর নিয়ে জানতে পারে কালাম ও মারুফকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বুকে, পিঠে গুলীর চিহ্ন এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
নিহত মোঃ আবুল কালাম সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের মেধাবী ছাত্র ছিল, একই সময়ে তিনি দেবহাটা থানা শাখা শিবিরের সেক্রেটারী ছিলেন। সে ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে অষ্টম। আর মারুফ হোসেন ছোটন কুলিয়ার গাঙআটির ক্বারী আশরাফুল আলমের ছেলে। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজের ভক্ত ছিল সে। যেখানে শুনতো সাঈদী সাহেবের ওয়াজ হবে সেখানেই ছুটে যেতো। সেই সাঈদী সাহেব জেলে থাকবে আর সে বাড়িতে বসে থাকবে তা হয় না বলেই মিছিল—মিটিংয়ে যেতো। আর এভাবেই এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা—কর্মীদের কাছে সে শত্রু হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত যৌথবাহিনীকে দিয়েই তাকে হত্যা করে— এমনই কথা জানান শহীদ মারুফ হোসেন ছোটনের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন।
যৌথবাহিনীর অভিযানে অংশ নেয়া একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ২৪ জানুয়ারি নিয়মিত মামলার আসামী গ্রেফতারের জন্য যৌথবাহিনী দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া এলাকায় অভিযান চালানো হয়। উক্ত এলাকা থেকে আবুল কালাম ও মারুফ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। রোববার ভোর রাতে তাদেরকে সখীপুর ইউনিয়নের নারিকেলি গ্রামে নিয়ে কালাম ও মারুফের বুকে ওসি তারকনাথ বিশ্বাস নিজে গুলী করে।
ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ইব্রাহিম। এ রিপোটারের সাথে কথা হয় সাতক্ষীরা কারাগারে। সাংবাদিক হিসেবে তৎকালি ধেনিক সংগ্রামের জেলা সংবাদদাতা আবু সাইদ বিশ^াসকে আটক করে সাতক্ষীরা পুলিশ। জেলখানায় থাকা কালে রিপোর্টারকে ইব্রাহিম জানান কালাম ও মারুফের সাথে তাকেও পৃথক স্থান থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এক দিন থানা হেফাজাতে রাখার পর পুলিশ টাকা দাবী করে। তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে ৪টি মামলা দিয়ে তাকে কোটে চালান দেয়। আর কালাম ও মারুকে থানায় হেফাজতে ব্যাপক মারপিট করে। শেষ রাতে তাদেরকে নিয়ে হত্যা করে। এ ভাবে ঐ রাতে ঘটনার বিবরণ দিলেন ইব্রাহিম।
অবিলম্বের কালাম ও মারুফ হত্যা কান্ডের সাথে জড়িত সকলকে গ্রেফতার পূর্বক দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)