সাতক্ষীরায় আসামিদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে স্কুলছাত্রীর পরিবার


এক মাত্র মেয়েকে নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিনপার করছি। সারাদিন ভাবি কিভাবে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ বানাবো। তার উপর সমাজ পতিদের ভয়ে গত একবছর ধরে মেয়ে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। স্বামী-স্ত্রী,মা ও মেয়ে মোট পরিবারের সদস্য সংখ্যা চারজন। বসবাস করার মত ঘর টুকু ছাড়া আর কোন জমি না থাকায় দিনমজুরী করে ও ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালিয়ে কোন রকমে সংসার চালাতাম । কিন্তু আর চালাতে পারছিনা। শনিবার সকালে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এসে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে এসব কথা বলেন সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কুমারখালি গ্রামের এক দিনমজুর ও হাড়িভাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেনির ছাত্রীর পিতা।
তিনি বলেন, আমার মেয়ে আশাশুনি উপজেলার হাড়িভাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেনির ছাত্রী। তার বয়স ৮বছর। সে ০৮.০৮.২০১৩ ইং তারিখে জন্ম গ্রহন করে। আমি একজন দিনমজুর (ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালক) এবং স্ত্রীও মা আমার সাথে দিনমজুরীর কাজ করে। মা বাবার একটি মাত্র মেয়ে সন্তান। অন্যের মৎস্য ঘেরে দিনমজুরী হিসাবে কাজ করে সংসার চালায়। কাজবন্ধ থাকলে ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালায়। আমার এক মাত্র মেয়ে গত দুই বছর থেকেই স্কুলে যেত এবং স্কুল থেকে সে কয়েকটি বই পায়। কিন্ত করোনা পরিস্থিতির জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় তার সময় কাটত বাড়ির পাশে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা করে।
তিনি আরো বলেন এভাবে ২০২০ সালে এসে আমি তার স্কুলে যোগাযোগ করে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি করার ব্যবস্থা করি। ১ম শ্রেণীর ভর্তির পর সকাল বিকাল পড়াশুনার পাশাপাশি স্কুল বন্ধুদের সাথে হই উল্লাস করে পার করে সে।
২০২১সালে ২য় শ্রেনীতে উঠলে পড়াশোনার আগ্রহটা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় সে নিজের মত সকাল সন্ধ্যায় পড়াশোনা করতো আর সারাদিন তার সময় কাটত বাড়ির পাশে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা করে।
একদিকে স্কুল বন্ধ অন্যদিকে (মা,বাবা ও ঠাকুরমা) আমরা অধিকাংশ সময় বাড়ি না থাকায় সে তার বন্ধুদের সাথে খেলতো। কিন্তু এই খেলাধুলা করাটায় তার জন্য অভিশাপ হয়ে গেল। কেননা ২০২১ সালের এপ্রিলের ২২ তারিখ তার জীবনে ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা। ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সে তার বাড়ি পাশের মন্দির মাঠে খেলাধুলা করছিল। এসময় প্রতিবেশী নিরাপদ মন্ডলের ছেলে গ্রাম্য ডাক্তার হীরালাল মন্ডল (৪৫) ও রনজিত মল্লিকের ছেলে অমিতাভ মল্লিক(৩৭), তাকে ডাক দেয় এবং খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে খেলাকরা মাঠের পাশের একটি ঘরে নিয়ে মুখ চেপে ধরে শরীরের স্পর্শকাতর স্থান(যৌনাঙ্গে) হাত দিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্ট করে। এসময় তার চিৎকার ও কান্নাকাটি করলে তার মা ও ঠাকুর মা শুনতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে তার মেয়ে ও প্রতিবেশি গ্রাম্য ডাক্তার হীরালাল মন্ডল উলঙ্গ অবস্থায় আছে। আর অমিতাভ মল্লিক তার মুখ চেপে ধরে রেখেছে। তখন তারা মেয়ে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেলে দুই লম্পট পালিয়ে যায়। তখন মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে মাকে জানায় তারা প্রতিদিন কাজে গেলে ওই দুই লম্পট (হীরালাল ও অমিতাভ) প্রায় খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে এসব খারাপ কাজ করে থাকে। তার মা দ্রুত আমাকে কে সংবাদ দেয় ও স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের অবহিত করেন। এনিয়ে ৩বার গ্রাম্য শালিশের আয়োজন করা হলেও অভিযুক্তরা হাজির না হয়ে উল্টো হুমকি দিতে থাকে। পরে আমি ২৯/০৪/২০২১ তারিখে বাদি হয়ে কালিগঞ্জ থানায় দুজনকে আসামী করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০(সং/০৩এর ৯(৪)(খ)/৩০ রুজু করি। মামলা নং ৫২।
স্কুল ছাত্রীর মা জানান, স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং বাড়িতে রাখা হয়। এরপর থেকে আমার মেয়ে কারও সাথে কথা বলতে চাইত না। তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব বেশি স্বচ্ছল না। আমরা একদিন কাজ না করলে সংসার ঠিক মতো চলেনা। তা উপর মেয়ের এই অবস্থা দেখে আমরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছি। এদিকে আমাদের মামলার প্রেক্ষিতে কালিগঞ্জ থানার পুলিশ এসে আসামীদের গ্রেফতার করে। কিন্তু এই আসামীরা ৩মাস জেলে থাকার পর হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে মামলা তুলে নিতে হুমকী দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কোর্টে একটি মিথ্যা মামলাও করেছে তারা। বর্তমান আমার মেয়ে কোথাও খেলতে গেলে অভিযুক্ত পরিবারের সদস্য বিভিন্ন ভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আসামীরা এলাকায় ফিরে আসার পর আমরা আবাও নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছি এবং ভয় পারছি। বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখবার জন্য প্রশাসনের উদ্ধর্তন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নির্যাতিত স্কুল ছাত্রীর পরিবার।
মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ও সাংবাদিক নেতা মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারনে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার ফলে সাতক্ষীরায় ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ধর্মীয় অনুশাসন কেও দায়ি করেণ তিনি।
জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম জানান, দেশে কিছু ব্যক্তির হাতে অবৈধ পয়সা,অবৈধ ক্ষমতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি কারনে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে । যার ফলে শিশু ও নারী ধর্ষণ এবং নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জন্য মানুষকে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কালিগঞ্জ থানার সাব-ইন্সেপেক্টর (নিরস্ত্র) গোবিন্দ জানান, স্কুল ছাত্রীর পিতার দেওয়া মামলাটি সত্যতা পাওয়ার রেকার্ড করে অভিযুক্ত দুই আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালত থেকে জামিন নিয়েছে তারা। শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা তিনমাসের মধ্যে আদালতে চার্জসিট দাখিল করার নির্দেশ থাকায় গত ৬মাস আগে চার্জসিট দিয়েছি। এখন আদালত যে সাজা দেন তাই হবে আসামীদের। নতুন ভাবে অন্য কোন সমস্যা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইন গত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
