সূবর্ণ জয়ন্তীতে বীরত্বগাঁথা মহান বিজয় দিবস
‘সূবর্ণ জয়ন্তীতে বীরত্বগাঁথা মহান বিজয় দিবস’
প্রফেসর মো. আবু নসর
জীবনের প্রতিটি সূর্যোদয় বিজয়ের-ই সূচনা। জীবনের প্রতিটি সূর্যাস্ত বিজয়ের-ই বর্ননা। বিজয় মানে বাঁচার মতো বেঁচে থাকা। বিজয় মানে স্বাধীনতাকে হৃদয়ে আকড়ে ধরে রাখা।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকাননে বিদেশি বেনিয়াদের কাছে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌল্লা পরাজিত ও কয়েকদিন পর নিহত হওয়ার পরপরই মূলত শুরু হয় এই জাতির মুক্তির সংগ্রাম। ফকির মজনু শাহ, তিতুমীর, হাজী শরিয়াতুল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তি কামনায় যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো সেটাই পরবর্তীতে সিপাহী বিপ্লব, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং পাকিস্তান লাভের মধ্য দিয়ে বিকশিত ও প্রসারিত হয়। পাকিস্তান অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের হটকারিতা এবং শোষনের জন্য এদেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় অনাস্থা ও অবিশ্বাসের বিভেদরেখা। সেইসাথে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী আওয়ামী লীগকে মেনে না নেওয়ার পর বিক্ষোভে ফেঁটে পড়ে দেশের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, সামরিক-বেসামরিক মানুষ। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শোষনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ও তার শেষ অধ্যায়ে টানা ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর অগ্নিঝরা ৭১’র ১৬ ডিসেম্বর বৃহষ্পতিবার পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭১ সাল থেকে ১৬ ডিসেম্বর শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় লাল তারিখ নয়, জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকল বাংলাদেশির স্বপ্নমালা আবেগঘন এই দিবস বছর ঘুরে আসে সাড়ম্বরে।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পিছনে ছিলো দেশ ও বিদেশের বহু মানুষের একক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধের ডিসকোর্সটা মূলত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে উৎসারিত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতার পথ বেয়েই মূলত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।
৮টি সিঁড়ি বাংলাদেশ অভ্যূদয়ের ৮টি তাৎপর্যপূর্ণ বছর- ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১।
৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ ঊজ্জ্বল হয়ে আছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগে ও আত্মনিবেদনে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করা মানে দেশ ও জাতিকে সম্মান করা।
বাঙ্গালি জাতির স্বপ্নপুরুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্ব ইতিহাসের প্রচন্ডতম রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনে বিশ্বের মানচিত্র একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি বিশ্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। সময়ের ছকবদ্ধ গাঁথুনিতে সারি বদ্ধ হয় ইতিহাস মানব সভ্যতা এবং স্বাধীনতা অর্জনের অমূল্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধ জাগ্রত চেতনার নাম। মুক্তিযুদ্ধ জাতির জীবনে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ চরম ত্যাগের অমরগাঁথা কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ জাতির বিবেকের অবি”ছেদ্য অংশ। আনন্দ বেদনায় মিশিত এক নিরব দলিল হল মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের অভূদয় তাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ইতিহাস অকস্মাৎ তৈরি হয়না। যিনি ইতিহাসের গতিধারা বদলে দেন তিনি নেতা। নেতা তৈরী করে ইতিহাস। ইতিহাস তৈরী করে মানুষ। আর এ জন্যেই ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত হয়ে আছে এক সাগর রক্তের ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
প্রত্যেক মানুষই এক একটি অপার সম্ভাবনার নাম। প্রত্যেকের হৃদয়ের মধ্যে আছে এক অন্তহীন ও দিগন্তহীন জগত। এই জগতটা হলো সততা, নৈতিকতা ও সর্বোপরি দেশপ্রেমের জগত। দেশ প্রেমের জগতে উদ্ধুদ্ধ হয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহবানে নির্ভিক বাঙালি মুক্তিসেনারা ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাঙালিরা মনের বল ও দেশপ্রেমের অদম্য টানেই পরাশক্তির ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পশ্চিমা স¤্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুগে যুগে এতদ্বঞ্চলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আপামর জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করেছে। ইতিহাসে ঈশা খাঁ থেকে ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, তীতুমীর, মাষ্টারদা সূর্যসেন তার জলন্ত প্রতীক। জাতীয় চেতনায় তাই বাঙ্গালি হিসেবে গর্ব করার যথেষ্ঠ আছে।
সুদীর্ঘ দুঃশাসন, শোষণ ও নীপিড়নের বহিঃপ্রকাশের ফলশ্রুতি স্বরূপ মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে মহান স্বাধীনতার ও বাংলাদেমের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ১৯৭১ এর ঐতিহাসিক ভাষণ সর্বপ্রণিধাযোগ্য। ঐতিহাসিক এ অর্থে যে, এ ভাষণের মধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার একটা উইলফোর্স, গাইড লাইন ও স্পিরিট ছিল। ৭ মার্চ ও বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ইতিহাস দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অবিস্মরনীয় দিন। দেশের ইতিহাসের মূল্যায়নের বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার অভূদয়ের প্রামান্য দলিল ও ঘোষনা পত্র। যার প্রতিটি শব্দ মুক্তিসংগ্রামের আর স্ব্ধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর সাহসী ও আপোষহীন নেতৃত্বে অনুপ্রানিত হয়েই পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল বাঙ্গালি জাতি।
বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ফলশ্রতি হল মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলন। স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিল প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ। অকুতোভয় বীর মুক্তিযুদ্ধাদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের গুরুত্ব অন¯ী^কার্য। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত মহান বিজয় দিবস। বিজয় দিবসে আমাদের প্রতিশ্রæতি হবে অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সৃজনশীল রাষ্ট্র গঠন করা। মহান বিজয় দিবস জাতির জীবনে স্মরনীয়, বরনীয়, চিরস্বরণীয়, অবিস্বরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার নিমিত্তে দীপ্ত শপথ এবং বিজয়ের মাসে দেশপ্রেমের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধারা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযোদ্ধাদের মহিমান্বিত ও দুঃসাহসিক বীরত্বের অমরগাঁথা কাহিনী কোটি কোটি বাঙ্গালি হৃদয়ের মনিকোঠায় চিরজাগরুক হয়ে থাকবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ফসল নষ্ট হয়নি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধসহ অধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সকল বীর শহীদের বীরত্বগাঁথা কাহিনী ও জীবনী জাতির ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- ঐতিহ্য ও চেতনাকে আজ আমরা হারাতে বসেছি, ভুলতে বসেছি। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিস্মৃত হতে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরসমুন্নত রাখা ও নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক চিত্র তুলে ধরা শুধু প্রয়োজনই নয় বরং একান্ত অপরিহার্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিজয়ের আনন্দ পৌছে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে। কালের বাস্তবতায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক- এটাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার, মর্যাদা, সম্মান ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করা জাতীয় কর্তব্য।এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ শুধু প্রশংসনীয় নয়, অবিস্মরণীয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বিজয়ের সূবর্ণ জয়ন্তীতে ৭১’র শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সহযোগিতা প্রদানকারী ও যুদ্ধকালীন নীপিড়িত সকলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখকঃ
সাবেক অধ্যক্ষ,
কলারোয়া সরকারি কলেজ,
সাতক্ষীরা
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)