কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন : জোয়ার নির্ধারণ করছে জাহাজ ছাড়া-পৌঁছানোর সময়!
সেন্টমার্টিনের স্থানীয় নাম ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপটির অবস্থান। পর্যটন করপোরেশনের তথ্যমতে, ১৯০০ সালের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এ দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে। জরিপে সাধু মার্টিনের নামে দ্বীপটির নামকরণ করা হয় ‘সেন্টমার্টিন’।
পরিবেশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এই দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী। দ্বীপটির কোমরসমান স্বচ্ছ পানিতে নামলে দেখা মেলে প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুকসহ অসংখ্য প্রাণীর।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৯ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন (ইসিএ) এলাকা ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালের প্রজ্ঞাপনে সেন্টমার্টিনকে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া ঘোষণা করে সরকার।
গত দুই দশকের নিয়ম পাল্টে চলতি মৌসুমে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ ছাড়ছে কক্সবাজার শহরের শেষ প্রান্ত নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট দিয়ে। দ্বীপের প্রকৃতি-প্রতিবেশ রক্ষায় সীমিত করা হয়েছে পর্যটক যাতায়াত। তাই দ্বীপে যেতে অনলাইন নিবন্ধনে পেতে হচ্ছে ট্রাভেল পাস। জাহাজের টিকিট নিশ্চিত হলেই জাহাজ কর্তৃপক্ষই বিনামূল্যে ট্যুরিজম বোর্ডের পাস কনফার্ম করছে। সবকিছু ঠিক হলেও কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাতে কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিনের পথে জাহাজ ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ বা সেন্টমার্টিন জেটিঘাট দিয়ে জাহাজের যাত্রা নিয়ন্ত্রণ করছে সামুদ্রিক জোয়ার!
অনুমোদনের পর ৩ ডিসেম্বর থেকে এমভি কর্ণফুলী জাহাজের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেন্টমার্টিন আসা-যাওয়া শিডিউলে জোয়ারেই যাত্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জোয়ারের ওপর নির্ভর করে ভোর ৬টায় কক্সবাজার এবং দুপুর ২টায় সেন্টমার্টিন থেকে ছাড়ছে জাহাজ। শিডিউল মিস হলে মিস হতে পারে দ্বীপযাত্রা বা স্থলে ফেরা। অবশ্য কোনো কোনো দিন সকাল ১০টায় যাত্রা করে বিকেল ৫টায় সেন্টমার্টিন থেকে ফেরা শুরুর সুযোগও দিচ্ছে সামুদ্রিক জোয়ার। পর্যটকবাহী জাহাজ বারো আউলিয়া ও কর্ণফুলীর কক্সবাজারের ইনচার্জ হোসাইন ইসলাম বাহাদুর এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যেদিন দুপুর ২টায় ফিরতি জাহাজ ধরতে হবে, সেদিন পর্যটকরা জাহাজ থেকে নেমে রিফ্রেশ হয়ে ঘণ্টাখানেক জেটিঘাটের আশপাশই কেবল ঘুরতে পারছেন।
সাগরে ভাটা হলে বাঁকখালী নদীতে পানি কমে যায়। এসময় জাহাজ বাঁকখালী নদীর বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে ঢুকতে পারে না। একই সমস্যা সেন্টমার্টিন জেটি ঘাটেও। তাই, জোয়ারের ওপর নির্ভর করেই সেন্টমার্টিন আসা-যাওয়ার শিডিউল মানতে হচ্ছে।
সম্প্রতি দেখা যায়, নুনিয়ারছড়া জেটিঘাট থেকে ভোর ৬টায় যাত্রা করে এমভি কর্ণফুলী, এমবি বারো আউলিয়া, এমভি কেয়ারি সিন্দাবাদ ও এমভি কেয়ারি ক্রোজ। নির্ধারিত যাত্রী নিয়ে একটার পর একটা জাহাজ ঘাট থেকে ছাড়ার পর পশ্চিম সবুজ প্যারাবন, পূর্বে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি পাঁচতলার দেড়শ কক্ষের খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প ফেলে অল্পক্ষণেই বাঁকখালী নদী অতিক্রম করে। কোয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির মাঝে আধাঘণ্টা চালিয়ে মহেশখালী চ্যানেল পেরিয়ে নেমে যায় বঙ্গোপসাগরে। সোনাদিয়া চ্যানেলে থেকে পূর্ব দিকে ১২৭ কিলোমিটার গেলেই সেন্টমার্টিন দ্বীপ। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে পৌঁছে যায় জাহাজ।
গত এক দশকে দৈনিক ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার প্রকৃতিপ্রেমী দ্বীপটিতে ভ্রমণ করেছেন। তাদের ৯৫ শতাংশের যাতায়াত ঘটে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে। ৩৪ কিলোমিটারের এই নৌপথের ১৭ কিলোমিটার নাফ নদী, বাকি ১৭ কিলোমিটার বঙ্গোপসাগর। নাফ নদীর পূর্ব দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আর পশ্চিমে টেকনাফ। তবে, চলতি বছরের শুরু থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেদেশের সেনা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মাঝে চলমান সংঘাতের কারণে গতবছর এবং চলতি মৌসুমে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
১ ডিসেম্বর কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট দিয়ে সেন্টমার্টিনের জাহাজ চলাচল শুরু হয়। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দৈনিক দুই হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে রাতযাপনের সুযোগ পাচ্ছেন। আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ সুযোগ থাকছে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সেন্টমার্টিনে বন্ধ হয়ে যাবে পর্যটকদের যাতায়াত।
সূত্রমতে, জাহাজে ওঠার আগে ঘাট পেরোনোর আগেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মীরা তল্লাশি করে পর্যটকদের সঙ্গে থাকা পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল রেখে দেন। সম্প্রতি সেন্টমার্টিনে পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার, প্রবালসহ সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ, বারবিকিউ পার্টি ও সৈকতে রাতের বেলা হইচই নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়া পর্যটক দম্পতি বলেন, ‘টেকনাফ হয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়া খুবই রোমাঞ্চকর। যাওয়ার পথে হাতের বাম পাশে মিয়ানমারের আরাকান, পশ্চিমে টেকনাফ আর জাহাজের পেছনে গাঙচিলের বিরচণ দেখা যায়। অনেক ভিডিওতে এসব দেখেছি। কিন্তু প্রথমবার গভীর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ছয়-সাত ঘণ্টার পথ ভালো লাগেনি। গভীর সাগরে জাহাজে ঠিকমতো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।’
পর্যটক সুলতানা বলেন, ‘টেকনাফ হয়ে আরও দুবার সেন্টমার্টিন গিয়েছিলাম। আগের মতো প্রাণবন্ত সেন্টমার্টিন এখন নেই। মানুষগুলো কেমন যেন মনমরা হয়ে আছে। বিবর্ণ হয়ে আছে গাছগাছালিও। মনে হয়েছে পরিচর্যা করা হয় না।’
সেন্টমার্টিন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার হাবিবুর রহমান জানান, গতবছরও ডিসেম্বর-জানুয়ারি সেন্টমার্টিন বাজার ছিল লোকারণ্য। পশ্চিমপাড়ায় যেতে অপেক্ষমাণ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের কারণে হাঁটা যেতো না। এবার সরকারি বিধিনিষেধে নির্ধারিত সংখ্যক পর্যটকের আগমনের কারণে বাজার প্রায় ফাঁকাই থাকছে। মন্দা যাচ্ছে আবনসনসহ অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যও।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘দ্বীপবাসী কেমন আছেন, তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা কেমন তার খোঁজ কেউ নিচ্ছেন না। চলমান তরুণ প্রজন্ম পর্যটনেই আয়ের পথ দেখে বড় হয়েছে। ফলে তারা অন্য পেশায় হঠাৎ নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছেন না। এ অবস্থায় দ্বীপের ১০ হাজার মানুষের মাঝে স্বল্পসংখ্যক পুরোনো পেশা মাছ ধরছেন। বাকিদের জীবনধারণ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)