অলংকার বেচবেন, না কিনবেন
বাংলাদেশ যে বছর স্বাধীন হয় তার আগের বছর সোনার ভরি ছিল ১৫৪ টাকা। আজকে ৫০ বছর পর দামটি শুনলেই অনেকে নিজের অজান্তেই হয়তো কথাটি বলবেন, এত্ত সস্তা! আসলে সোনা সব কালেই দামি ধাতু। যেমন বর্তমানের কথাই ধরুন, সোনার ভরি ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা। ভাবা যায়! দাম যে আর বাড়বে না, সেই চিন্তা আপাতত না করাই ভালো। দুনিয়াজুড়ে সোনার দাম আরও বাড়তে পারে, পূর্বাভাস কিন্তু এমনই।
সোনার দাম কেন বাড়ছে? মানুষ কেন সোনার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমরা একটু পরে আসছি। সোনার দাম হু হু করে দাম বেড়ে যাওয়ায় যাঁরা অলংকার তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন তাঁরা পড়েছেন মহা দুশ্চিন্তায়। জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরাও ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না, মুখ ভার করে সময় পার করছেন। অন্যদিকে যাঁদের ঘরে তুলনামূলক কম দামে কেনা অলংকার আছে তাঁরা আছেন মধুর সমস্যায়। বিক্রি করে দেবেন কি না, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়। আবার বেচলে লাভ কেমন মিলবে, তা নিয়েও চলছে বিস্তর হিসাব–নিকাশ। যাঁরা সোনার অলংকার বেচবেন বা কিনবেন, তাঁদের জন্যই আমাদের
এই প্রতিবেদন।
আসুন, প্রথমেই জেনে নিই সোনার দাম কত বাড়ল। দেশে গত বছরের প্রথম দিকে ২২ ক্যারেট সোনার ভরি ছিল ৪৮ হাজার ৯৮৯ টাকা, যা চলতি বছরের শুরুতে ৫৮ হাজার ২৮ টাকায় ওঠে। তো করোনাজনিত লকডাউনে আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ায় ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে সোনা আসা বন্ধ হয়ে যায়। আবার বিশ্ববাজারেও দাম বাড়তে থাকে। এই দুই কারণে গত ২৩ জুন ২২ ক্যারেট সোনার দাম এক লাফে ভরিতে ৫ হাজার ৮২৫ টাকা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি। ২৪ জুলাই আরেক দফা দাম বাড়িয়ে ৭২ হাজার ৭৮৩ টাকা করা হয়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সোনার দাম যেন পৌঁছে যায় পাহাড়ের চূড়ায়। এখন ভরি ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা। তাতে গত সাত মাসে ভরিতে দাম বেড়েছে ১৯ হাজার ১৮৮ টাকা। আর বর্তমানে ২১ ও ১৮ ক্যারেট সোনার দাম যথাক্রমে ৭৪ হাজার ৬৭ টাকা ও ৬৫ হাজার ৩১৯ টাকা।
এক যুগ আগেও দেশের জুয়েলারি ব্যবসায় বেশ বিশৃঙ্খলা ছিল। সোনার অলংকার ভাঙালে শেষ পর্যন্ত কতটুকু বিশুদ্ধ সোনা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সংশয় ছিল। তবে ২০০৭ সালে হলমার্ক বাধ্যতামূলক করে জুয়েলার্স সমিতি। এতে যেটি হয়েছে, অলংকারের গায়ে কতটুকু বিশুদ্ধ সোনা আছে, তা খোদাই করে লিখে দেয় বিক্রেতা। সেই সঙ্গে অলংকার কেনার রসিদে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হয়। সাধারণত অলংকার প্রস্তুত করার পর নির্দিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠানে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে তা পরীক্ষা করে বিশুদ্ধ সোনার পরিমাণটি বের করা হয়। অবশ্য ব্র্যান্ড ও স্বনামধন্য জুয়েলার্সগুলো সেটি মেনে চললেও মফস্বলের ছোট-মাঝারি প্রতিষ্ঠান হলমার্কের বিষয়টি মানে না।
জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা জানালেন, দেশে বর্তমানে ২২, ২১ ও ১৮ ক্যারেটের সোনার অলংকার বেশি তৈরি হয়। সনাতন পদ্ধতির অলংকার সেই অর্থে তৈরি হয় না। ২২ ক্যারেটের এক ভরি অলংকারে ১৪ আনা ২ রতি বিশুদ্ধ সোনা থাকে। ২১ ক্যারেটে ১৪ আনা ও ১৮ ক্যারেটে ১২ আনা বিশুদ্ধ সোনা থাকে। সনাতন পদ্ধতির অলংকারে বিশুদ্ধ সোনার পরিমাণ বড়জোর ১০ আনা। আর জানেন তো, ১৬ আনায় ১ ভরি, ৬ রতিতে ১ আনা।
বাজারে দাম হু হু করে বাড়ছে
অন্যদিকে ঘরে আছে কম দামে কেনা সোনার অলংকার
তাই অনেকেই হিসাব কষছেন কী করবেন
আসল কথায় আসা যাক। পুরোনো অলংকার বিক্রি করলে মুনাফা কত? সাধারণত পুরোনো অলংকার জুয়েলার্সে বিক্রি করতে গেলে তারা ওজন করার পর তা কোন ক্যারেটের সোনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হবে। তারপর অলংকারটির বর্তমান ওজন থেকে ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হবে। ধরুন, আপনি পাঁচ বছর আগে ৪৩ হাজার টাকায় ২২ ক্যারেটের এক ভরি ওজনের অলংকার কিনেছিলেন। এখন সেটি বিক্রি করতে গেলে আপনি ৬১ হাজার ৭৭২ টাকা পাবেন। তাতে ভরিতে আপনার মুনাফা হবে ১৮ হাজার ৭৭২ টাকা। ২১ ও ১৮ ক্যারেটের অলংকার হলে মুনাফা ভিন্ন হবে।
অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পরামর্শ, অলংকারটি যে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা সেখানেই নিয়ে যান। সঙ্গে অবশ্যই রসিদটি নিতে ভুলবেন না। অন্য কোনো জুয়েলার্সে অলংকার বিক্রি করতে গেলে মুনাফা কিছুটা কমে যাবে। কারণ, তখন তারা অলংকারের বর্তমান ওজন থেকে ২২-২৪ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করবে।
পুরোনো অলংকার বিক্রিতে মুনাফা বেশি করার আরেকটি উপায় আছে। যদিও সেটি ঝুঁকিপূর্ণ। তবে বিশ্বস্ত জুয়েলারি ব্যবসায়ী থাকলে সে পথে হাঁটতে পারেন। তা হচ্ছে, অলংকার গলিয়ে পাকা সোনায় রূপান্তর করে বিক্রি করা। গত বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে পাকা সোনার ভরি ছিল ৭০ হাজার টাকা। সে হিসাবে আপনার ৪৩ হাজার টাকায় কেনা ২২ ক্যারেটের এক ভরির অলংকার পাকা করে বিক্রি করলে দাম পাওয়ার কথা ৬৪ হাজার ১২০ টাকা। যেটি জুয়েলার্সে নিলে পাবেন ৬১ হাজার ৭৭২ টাকা। তবে ভরিতে ২ হাজার ৩৪৮ টাকা বেশি মুনাফা করতে চাইলে ঝুঁকিও কিন্তু নিতে হবে। তাই দুই পথের কোনটিতে যাবেন, সিদ্ধান্ত আপনার।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা সম্প্রতি ৯ ভরি ৩ আনা ওজনের সোনার অলংকার গলিয়ে পাকা করে পেয়েছেন ৭ ভরি। তখন পাকা সোনার দাম ছিল ৫৭ হাজার টাকা। তাঁর অলংকার কেনা ছিল প্রতি ভরি ২৩ হাজার টাকায়। তাতে ২ লাখ ১৩ হাজার টাকার অলংকার তিনি বিক্রি করেছেন ৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকায়। বললেন, অলংকার বিক্রির টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন। তাতে বছরে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা মুনাফা পাবেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে সোনার দাম যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে চলতি বছরের শুরুতে যাঁরা অলংকার কিনেছিলেন তাঁরা বিক্রি করলেও মুনাফা পাবেন। তবে নতুন করে অলংকার কেনার ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, ‘সোনার বাজার অস্থির। তাই যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই কিনুন। বেশি কিনতে যাবেন না। আর অবশ্যই হলমার্কযুক্ত অলংকার কিনুন। রসিদেও কত ক্যারেটের অলংকার কিনেছেন, সেটি স্পষ্ট করে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লিখে নিন।’
ইদানীং অনেকেই কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করছেন, সোনার দাম কি আরও বাড়বে? উত্তর হচ্ছে, নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যায় না। মূলত করোনার দ্বিতীয় দফা ঢেউ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনা, বৈশ্বিক শেয়ারবাজারের অস্থিরতা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ডলারের দাম কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা সোনাকে নিরাপদ বিনিয়োগ বলে মনে করছেন। তাতে সোনার চাহিদা ব্যাপক বেড়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা অতীতে কখনোই ঘটেনি।
জানতে চাইলে জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ‘বিশ্ববাজারের যে পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে সোনার দাম আরও বাড়বে। প্রতি আউন্স ২ হাজার ১০০ ডলার হলেই আমাদের আবার ভরিতে ৪ হাজার ৪৩৩ টাকা বাড়াতে হবে।’ তিনি বললেন, সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরোনো অলংকার বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার তাঁর প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্রে শতাধিক ক্রেতা অলংকার বিক্রি করতে আসেন।
বিশ্ববাজারে গতকাল বিকেল পাঁচটায় প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল ২ হাজার ৫৭ ডলার। লেবাননের বৈরুতে বিস্ফোরণের পর নতুন করে সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী। তবে দাবার চাল যেকোনো সময় আবার ঘুরে যেতে পারে। ফলে বেচবেন না কিনবেন সিদ্ধান্ত আপনার।
সুত্র প্রথম আলো
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)