মহামারির থাবায় ব্যাংকে নগদ অর্থের টান


মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) থাবায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ওলট-পালট হয়ে গেছে।
এর ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম তথা জীবনযাত্রায়ও। আয় কমে যাওয়ায় সংসারের খরচ কমাতে অনেকেই সঞ্চয় ভেঙেছেন। আগে বেশি পরিমাণে সঞ্চয় করা অনেকেই খরচের ঘানি টানতে গিয়ে সঞ্চয় কমিয়েছেন। আবার সুদ হার কমে যাওয়ায় ব্যাংকে টাকা রাখার প্রবণতাও কমেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকখাতে এক প্রকার নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ের আর্থিক চিত্র প্রকাশ করেছে ব্যাংকগুলো। তালিকাভুক্ত ৩১টি ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৫টি ব্যাংক জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের হিসাব প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ১৫টি ব্যাংকই তারল্য বা নগদ অর্থ সংকটে রয়েছে বলে জানিয়েছে। এ ব্যাংকগুলোতে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা তারল্য সংকট আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মহামারিকালে করোনার প্রকোপের মধ্যে পড়ে অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। আবার কাজ থাকলেও আয় কমে গেছে একটি বড় অংশের। কাজ হারানো অনেকেই সংসার চালাতে সঞ্চয় ভেঙেছেন। আবার কাজ থাকার পরও আয় কমে যাওয়া ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছেন। এতে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ কমে গেছে। যা ব্যাংকের তারল্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সম্প্রতি ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ’র এক জরিপে উঠে এসেছে, মহামারি করোনার কারণে ৮০ শতাংশ পরিবার খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছে ৬৪ শতাংশ পরিবার। আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশের।
এছাড়া মহামারিকালে ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। এতে বিতরণ করা ঋণ আদায় কম হয়েছে। আবার মহামারির আগেও কিছু কিছু ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। যে কারণে মহামারি শুরুর পর অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন।
তাছাড়া সুদ হার কম হওয়ার কারণে একটি অংশ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে শেয়ারবাজার বা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করেছেন। ব্যাংকের তারল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পেছনে এগুলোও ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট সাময়িক হলে খুব একটা অসুবিধা হবে না। তবে তারল্য সংকটের মেয়াদ দীর্ঘ হলে তা ভালো ফল বয়ে আনবে না। এই তারল্য সংকটে ব্যাংক যেমন সমস্যায় পড়বে, তেমনি সার্বিক অর্থনীতিতেও চাপ সৃষ্টি করবে। ব্যাংকের তারল্য সংকট থাকলে গ্রাহকরা তাদের অর্থ ফেরত পেতে বিড়ম্বনায় পড়বেন।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে এবি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, স্টান্ডার্ড ব্যাংক এবং উত্তরা ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এ ব্যাংকগুলোতে ঋণাত্মক ক্যাশ ফ্লো আছে ১২ হাজার ৮৮১ কোটি টাকার ওপরে।
তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ইউসিবি এখনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাশ ফ্লো পজিটিভ রয়েছে। এর মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ঋণাত্মক ছিল।
ঋণাত্মক থেকে ক্যাশ ফ্লো ধনাত্মক হওয়ার কারণ হিসেবে সাউথইস্ট ব্যাংক জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় ঋণ বিতরণ কমে যাওয়া এবং ধার বেড়ে যাওয়ায় ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক হয়েছে। আর ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়ার কারণ হিসেবে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক জানিয়েছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানত কমে যাওয়ায় ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ার অর্থ নগদ টাকার সংকট দেখা দেয়া। যে প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক, ওই প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থ সংকট ততো বেশি। একটি প্রতিষ্ঠানের অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়লে ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা পরিচালনায় নানামুখী সমস্যা দেখা দেয়। সময় মতো পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সিটি ব্যাংক। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২২ টাকা ৭ পয়সা। এতে প্রতিষ্ঠানটিকে দুই হাজার ৩৫৫ কোটি ৩২ লাখ টাকার তারল্য সংকটে পড়তে হয়েছে।
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির নগদ অর্থের ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ৬৫৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। আর শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক ১৫ টাকা ৮৫ পয়সা। শেয়ারপ্রতি ১১ টাকা ৫৭ পয়সা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ার মাধ্যমে পরের স্থানে রয়েছে ব্যাংক এশিয়া। প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণাত্মক ক্যাশ ফ্লো এক হাজার ২৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
এছাড়া এবি ব্যাংকের এক হাজার ৩৪১ কোটি ৩২ লাখ, ব্র্যাক ব্যাংকের ৯২০ কোটি ১৫ লাখ, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ৪৫৯ কোটি ১৯ লাখ, এক্সিম ব্যাংকের ১৬৮ কোটি ৫ লাখ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৩৩ কোটি ৫৮ লাখ, আইএফআইসি ব্যাংকের ৯৬০ কোটি ৫৮ লাখ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১২৪ কোটি ৯ লাখ, এনআরবিসি ব্যাংকের ৭২৪ কোটি ৯৯ লাখ, ওয়ান ব্যাংকের ৫৫৮ কোটি ৬৫ লাখ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৩০৪ কোটি ৬১ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯২৪ কোটি ৬১ লাখ এবং উত্তরা ব্যাংকের ৮৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ঋণাত্মক ক্যাশ ফ্লো রয়েছে।
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, ‘ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ার অর্থ নগদ অর্থের সংকট দেখা দেয়া। একটি মেয়াদে প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ ফ্লো যে পরিমাণ ঋণাত্মক হবে, প্রতিষ্ঠানটিতে ওই পরিমাণ নগদ অর্থের সংকট ছিলে বলে ধরে নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প সময়ে ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক থাকলে তেমন সমস্যা নাও হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক থাকলে তার পরিণতি খুব খারাপ হতে পারে। গ্রাহকরা টাকা তুলতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন।’
অধ্যাপক বখতিয়ার বলেন, ‘ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ার পেছনে বিতরণ করা ঋণ ঠিকমত আদায় না হওয়া এবং আমানত সংগ্রহ কম হওয়াসহ বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। এখন সুদ হার কম হওয়ায় অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কেউ কেউ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে। আবার করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে খরচ করেছে। সব মিলেই ব্যাংকগুলোর ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।’
সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে এ বিষয়ে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকগুলো আমানত কম পাচ্ছে। আবার কিছু গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন। এসব কারণে ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়তে পারে। সার্বিকভাবে এ পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। তবে পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়েছে বলে আমি মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়া বা তারল্য সংকট দেখা দিলেও বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তা হয়তো বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে না। তবে এটি অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। যা অর্থনীতির জন্য ভালো সংবাদ নয়।’
তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ব্যাংকের গ্রাহকদের একটি অংশ নিজের টাকা নিজের কাছে রাখাই নিরাপদ মনে করেছেন। এটিও ক্যাশ ফ্লো কমার একটি কারণ।
তিনি বলেন, ‘কোভিডের আগেও অনেক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। কোভিডের মধ্যে তাদের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এতে গ্রাহকদের একটি অংশ ব্যাংকে টাকা রাখার চাইতে নিজের টাকা নিজের কাছে রাখাই নিরাপদ মনে করেছেন। যে কারণে তারা ব্যাংকে না রেখে টাকা নিজেদের কাছে রেখেছেন, যেটাকে বলে—ক্যাশ ইন হ্যান্ড।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে—কোভিডের কারণে সমস্যায় পড়ায় অনেকে ব্যাংক থেকে ডিপোজিট ভেঙে খরচের টাকা তুলেছেন। আবার আয় কমে যাওয়ায় এক শ্রেণির মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখা কমিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া কোভিডের কারণে ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে। এতে ঋণ আদায় কম হয়েছে। এটিও ব্যাংকের তারল্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার অন্যতম একটি কারণ।’

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
