এমপি আনার হত্যা : এমপি হওয়ার স্বপ্ন বিভোরে হত্যার মূল পরিকল্পনায় মিন্টু!
সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর এমপি হওয়ার স্বপ্ন। এমপি আনারের ঝিনাইদহ-৪ আসনে মিন্টুর নির্বাচন করার খায়েস ছিল দীর্ঘদিনের।
সর্বশেষ দুটি সংসদ নির্বাচনেই মিন্টু এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিট পাওয়ার জোর লবিং চালান। কিন্তু পেরে ওঠেননি তিনি। সর্বশেষ ২০২২ সালে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের সময়ও সাধারণ সম্পাদক পদের বাধা হয়ে দাঁড়ান এমপি আনার। ফলে ঠান্ডা মাথায় আনারকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন মিন্টু। আনার হত্যা মিশন শেষ করতে দুই কোটি টাকার বাজেটও করেন তিনি। খুনি ভাড়া থেকে শুরু করে সার্বিক কাজের দায়িত্ব দেন মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুকে।
এ গ্যাস বাবুই আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন ও মূল কিলার চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্যার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেন। গ্যাস বাবু এমপি আনারকে হত্যার আগে ৬ মে শিমুলকে দুই কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই অনুযায়ী হত্যা মিশন শেষে ১৬ মে আনারের ছবি গ্যাস বাবু ও মিন্টুর ফোনে পাঠায় শিমুল। ছবি পাঠানোর পর শিমুলকে ফোনও করেন মিন্টু। শাহীনের সঙ্গেও হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত হতে কথা বলেন তিনি।
পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক এ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই খুনিরা শাহীনের সঙ্গে আনারের স্বর্ণ চোরাচালানের দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আনেন। গ্রেফতারের প্রথম পর্যায়ে খুনিরা ডিবি পুলিশকেও এ বিষয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র বলছে, মূল কিলার শিমুলের জবানবন্দি এবং খুনিদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসে আছে হত্যাকাণ্ডে আদ্যোপান্ত। আর এ হত্যার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সব পর্যায়েই আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা পাচ্ছে ডিবি পুলিশ। মঙ্গলবার মিন্টুকে আটকের পর দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি ডিবি পুলিশের কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তবে তার বিরুদ্ধে থাকা ডিজিটাল এভিডেন্সের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারছেন না। ডিবির জেরার মুখে অনেক প্রশ্নের অসংলগ্ন জবাবও দিচ্ছেন মিন্টু।
এদিকে গ্রেফতারের পর মিন্টুকে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন এ আদেশ দেন।
মিন্টুর গ্রেফতারের বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে নিজ কার্যালয়ে অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তে কারও সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো সংশ্লিষ্টতা না পেলে আমরা কাউকে ডাকি না। শিমুল ভূঁইয়ার ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এবং মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাবুর জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ব্যাপক আকারে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। সেই কারণে তাকে আমরা সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। প্রয়োজনে শিমুলকে আবার রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
হারুন অর রশীদ আরও বলেন, আনারের লাশ গুম করে ১৫ মে শিমুল দেশে আসেন। পরে শিমুল ঢাকা এলে তার সঙ্গে মিন্টুর প্রতিনিধি যোগাযোগই বা কেন করলেন? ১৬ মে থেকে মিন্টু জানেন এমপি আনার খুন হয়েছেন অথচ আমরা জানি ২২ মে। এমপি আনারকে হত্যার পর তোলা ছবি যদি মিন্টু ১৬ মে দেখে থাকেন তাহলে তিনি কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেননি। টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়টিও গ্রেফতারদের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এসেছে। সব কিছুই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ডিজিটাল ডিভাইস এবং ডিজিটাল এভিডেন্স বিশ্লেষণ করে আনার হত্যার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পায় ডিবি। শিমুল আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ আগে ৬ মে তারা আরেকজন নেতার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছেন। সেখানে অর্থের লেনদেনের কথা বলেছেন ওই নেতা, যার পরিমাণ দুই কোটি। এর মধ্যে খুনিরা দেশে ফেরার পরে দেবে ২০ লাখ আর ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেবে ২৬ থেকে ২৯ মে এর মধ্যে।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্য ও ডিভাইস পর্যালোচনা করে ডিবি জানতে পেরেছে আক্তারুজ্জামান শাহীনের পক্ষে লিয়াজোঁ অফিসার হিসাবে কাজ করেছেন শিমুল ভূঁইয়া। একইভাবে মিন্টুর পক্ষে লিয়াজোঁ অফিসার হিসাবে কাজ করেছেন বাবু। জিজ্ঞাসাবাদে বাবু স্বীকার করেছেন, মূল কিলারের সঙ্গে তিনি একাধিকবার মিটিং করেছেন। তার সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথাও হয়েছে। একপর্যায়ে বাবু মৃত এমপি আনারের ছবিও মিন্টুকে দিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে বাবু জানিয়েছেন, তার তিনটি মোবাইল ফোনই আক্তারুজ্জামান শাহীন নিয়ে গেছেন। কী কারণে ফোন নিয়ে গেছে সেই বিষয়ে বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলায় মিন্টুর রিমান্ড শুনানিতে তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের পুরো বিষয়টি জানতেন মিন্টু। এরপর বিচারক মিন্টুকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি কিছু বলবেন? জবাবে মিন্টু বলেন, আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। এমপি মনোনয়ন চাওয়াই আমার অপরাধ।
মিন্টুর রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এমপি আনার হত্যায় সরাসরি জড়িত গ্রেফতার শিমুল আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানে আসামি সাইদুল করিম মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা আছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্তে মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। বর্তমানে পুলিশ রিমান্ডে থাকা আসামি কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু এমপি আনার অপহরণে মিন্টুর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। মূল পরিকল্পনাকারী শাহিন আসামি মিন্টুর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন।
শিমুল তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, চলতি বছরের ৫ ও ৬ মে এমপি আনারকে প্রলুব্ধ করে অপহরণ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহিন আসামি সাইদুল করিম মিন্টুর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন এবং এমপি আনার হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সাপেক্ষে আর্থিক লেনদেনের কথা বলেন। হত্যার প্রমাণস্বরূপ ছবি আদান-প্রদান করা হয়।
এমপি আনার ১২ মে ভারতে যান। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। তার শরীরের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংকে। আর হাড় ফেলা হয় খালে। তবে ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে।
ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন (২৪) অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসাবে এ পর্যন্ত ১২ জনের নাম বেরিয়ে এসেছে। গ্রেফতার হয়েছেন সাত জন। তারা হলেন-বাংলাদেশে গ্রেফতার শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর, সেলেস্তি, বাবু ও মিন্টু। এদের মধ্যে বাবু ও মিন্টু ছাড়া অন্যরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া ভারতে গ্রেফতার আছে সিয়াম ও কসাই জাহিদ।
আর তিনজনের নাম এসেছে, যারা হত্যাকাণ্ডের সরাসরি জড়িত নয়। তবে আর্থিক লেনদেনের তারা ব্যবহৃত হতে পারে বলে ডিবির সন্দেহ। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। এছাড়া পলাতক আছেন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল।
কালীগঞ্জে আনার হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন : আনার হত্যাকাণ্ডে সাইদুল করিম মিন্টুকে মূল পরিকল্পনাকারী বলে দাবি করেছেন মেয়র আশরাফুল আলম। তিনি বলেন, এ হত্যায় কালীগঞ্জের অনেকে অর্থের জোগানদাতা রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করলে তাদের নামও বেরিয়ে আসবে। বৃহস্পতিবার বিকালে উপজেলার ৭ নম্বর রায়গ্রাম ইউনিয়নে আয়োজিত এমপি আনার হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধনে এসব কথা বলেন তিনি। ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের দুলাল মুন্দিয়া নামক স্থানে মানববন্ধনের আয়োজন করে রায়গ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ।
মানববন্ধনে উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডু, কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী বক্তব্য দেন।
মিন্টুকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে মানববন্ধন : সাইদুল করিম মিন্টুকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকালে জেলা দোকান মালিক সমিতির আয়োজনে শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য দেন জেলা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম মন্টু, সহসাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান, মুন্সি মার্কেটের সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি, চেম্বার অব কমার্সের নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, এমপি আনার হত্যার প্রায় এক মাস পর মিন্টুকে ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মিন্টুকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য গোয়েন্দা পুলিশের প্রতি দাবি জানান তারা।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)