জনকল্যাণের নামে রাস্তার জন্য নদী থেকে বালু উত্তোলন!
সাতক্ষীরায় জনকল্যাণের নামে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে।
সদর উপজেলার ১৩নং লাবসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবদুল আলিমের প্রত্যক্ষ মদদে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইকবাল জমাদ্দার এ বালু উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির দাবি চেয়ারম্যান আবদুল আলিমের চাপে পড়েই নদী থেকে বালু উত্তোলন করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তার ভাষ্য, নদী থেকে বালু না উঠিয়ে অন্যত্র থেকে বালু কিনে ট্রাকযোগে রাস্তায় ফেলতে যে খরচ নদী থেকে বালু উত্তোলন করে রাস্তায় ফেলতে তাদের আরও বেশি টাকা ব্যায় হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (০১ জুলাই) সকালে সরেজমিনে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের খেজুরডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ওই গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বেতনা নদীতে পৃথক দুটি ড্রেজার মেশিন দিয়ে ‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০’ এর তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০’ এর ৪ এর ‘খ’ ধারায় সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা, অথবা আবাসিক এলাকা হতে সর্বনিম্ন ১ (এক) কিলোমিটার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত সীমানার মধ্যে থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও খেজুরডাঙ্গায় বেতনা নদীর যে অংশ থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তার তীর ঘেষে শতাধিক পরিবারের বসবাস। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মন্দিরের মতো ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও আছে।
আইনটির ৪-এর ‘গ’ ধারায়, বালু বা মাটি উত্তোলন বা বিপণনের উদ্দেশ্যে ড্রেজিংয়ের ফলে কোন নদীর তীর ভাঙ্গনের শিকার হতে পারে এরূপ ক্ষেত্রেও বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ। অথচ এসবের তোয়াক্কা না করেই একই আইনের ৫নং ধারার ভূ-গর্ভস্থ বা নদীর তলদেশ হতে বালু বা মাটি উত্তোলন সংক্রান্ত বিশেষ বিধানও অমান্য করছেন বালু উত্তোলনকারীরা।
এদিকে বালু উত্তোলন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের সাথে কথা বলে লাভ নাই। আমরা শ্রমিক, শ্রম দিতে এসেছি। আপনারা চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলেন তার নির্দেশনায় এখান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
স্থানীয়দের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংখ্যালঘু হওয়ায় প্রথমে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে মুখ খুলতে দ্বিধা করলেও পরে শোনান আশঙ্কার কথা। তারা জানিয়েছেন, বাড়ির মাত্র কয়েকফুট সামনেই নদী। এ নদী থেকে বালু উত্তোলন করায় আমাদের ঘরবাড়ি, বাড়ির সামনের রাস্তা ধ্বসে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। আবার নদীর পাড় ভেঙ্গে চলতি বর্ষা মৌসুমে বন্যার কবলে পড়ার ভয়ও কাজ করছে তাদের মনে।
খেজুরডাঙ্গা পূর্বপাড়া গ্রামের গৃহবধূ সুচিত্রা রানী সরকার বলেন, এভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করার ফলে আমদের ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আমরা এর প্রতিকার চাই।
একই এলাকার কণ্ঠরাম সরকার বলেন, আমাদের বাড়ির সামনে থেকে বালু উঠানো হচ্ছে আমরা খুব বিপাকে পড়েছি। চেয়ারম্যান সাহেবকে বলেছি যে, আপনার নাম করে এখান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, আপনি একটা ব্যবস্থা নিন। কিন্তু তিনি এখনো কোন ব্যবস্থা নেননি।
এ বিষয়ে লাবসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবদুল আলিম বলেন, খেজুরডাঙ্গা আর.কে মাধ্যমিক বিদ্যালয় মোড় থেকে খেজুরডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ২.২ কিলোমিটার রাস্তার কাজ হচ্ছে ১কোটি ৩০লক্ষ টাকা ব্যায়ে। শিডিউলে এ রাস্তায় মাত্র ১৭ইঞ্চি বালু দেওয়ার কথা কিন্তু এতো কম বালু দিলে রাস্তার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হবে এবং দ্রুতই রাস্তাটি নষ্ট হয়ে যাবে এজন্য সাতক্ষীরা সদর এমপি মহোদয় এবং এসিল্যান্ডের সাথে কথা বলে তাদের অনুমতি নিয়েই নদী থেকে বালু উত্তোলন করে রাস্তায় ৩ফুট করে বালি দিতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেছি এবং তারা আমার এ অনুরোধ রেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, এই বালু উঠিয়ে আমার কোন লাভ নেই। এতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানেরও লাভ নেই। শুধুমাত্র এলাকাবাসীর কথা ভেবে এবং সরকারের ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা যেন নষ্ট না হয় সেজন্যই নদী থেকে বালু উঠাতে বলেছি।
তবে এ বিষয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মো. বেনজির আহমেদ বলেন, আমরা যদি অন্যত্র থেকে বালু কিনে নিয়ে আসি সেক্ষেত্রে প্রতি ফুট বালুর দাম পড়বে ০৭টাকা। নদী থেকে বালু তুলতেও আমাদের প্রতি ফুটে ০৭টাকা বা তার বেশি খরচ হচ্ছে। শুধুমাত্র চেয়েরম্যানের চাপে পড়েই আমাদের নদী থেকে বালু তুলতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইকবাল জমাদ্দার এর কর্ণধর ইকবাল জমাদ্দার বলেন, ওই রাস্তার ইস্টিমেটে ১৭ ইঞ্চি বালু দেওয়ার কথা। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব আমাদেরকে অনুরোধ করেন বালুটা যেন তিন ফুট দেই তা না হলে রাস্তা বর্ষাকালে তলিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা ওই অতিরিক্ত বালু দিতে রাজি না হলে উনি আমাদেরকে নদী থেকে শুধুমাত্র উত্তোলন খরচ দিয়ে বালি উঠিয়ে রাস্তায় দিতে বলেন। আমরা যতদূর জানি উনি বালি উঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছেন।
এ বিষয়ে সদর ভূমি কর্মকর্তার মন্তব্য জানার জন্য তার ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার কল করলেও নাম্বার বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জনবসতি এলাকা থেকে বালু উত্তোলন প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, নদী থেকে বালু উত্তোলন করে তো রাস্তায় দেওয়ার কথা না। আর আমি এব্যাপারটা জানতাম না। আপনার কাছ থেকেই প্রথম জানলাম। আমি একটু খোঁজ-খবর নিয়ে দেখছি কি করা যায়।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)