আমি একজন পরিবহন শ্রমিক

ব্যাগটা গুছিয়ে রেখো,ভোরে বেরিয়ে যেতে হবে। পারলে তুমিও আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেও বলেই শুয়ে পড়লাম। খুব ভোরে ফ্রেশ হয়ে মায়ের দোয়া নিয়ে ব্যাগটা হাতে বেরিয়ে যাবো এমন সময় জাহানারা বললো বাসায় বাজার নেই। জাহানারা আমার সহধর্মিণী,আমাদের ১ বছরের খোকা ফাইয়াজ বাবু। মানিব্যাগ থেকে ২’শ টাকা বউটার হাতে দিয়ে বললাম আজ এটুকু দিয়েই চেষ্টা করে নাও। আসার সময় আমি কিছু নিয়ে আসবো। বউ আমার একটা হাসি দিয়ে বললো, ” সাবধানে যেও”। মুচকি হাসি দিয়ে বিদায় নিলাম।
সকাল ৫:৩০মিঃ। দিনের প্রথম টিপে আমার গাড়ির সিরিয়াল।খোকনরে সাতে নিয়ে গাড়ি ধুয়ে নিয়ে লাইনে লাগিয়ে দিলাম।খোকন আমার হেলপার,বয়সে তাগড়া যুবক।ওর বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমার সাথেই কাজ করে। সময় মতো কয়েকজন যাত্রী নিয়ে সাতক্ষীরা কাউন্টার থেকে ছেড়ে দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। কিছুদূর আসতেই বৃষ্টি শুরু হলো,রাস্তার উপর থাকা মাটিতে গাড়ির পেছনের চাকা স্লিপ করছে।কোনো মতে জায়গাটা পার হয়ে কলারোয়া কাউন্টারে পৌঁছালাম।বএদিকে সুপারভাইজার যাত্রী উঠানোর কাজে ব্যস্ত,আমি কয়েকটা পান নিয়ে স্টিয়ারিং হাতে গাড়ি ছেড়ে দিলাম।
যশোর পৌঁছাতেই জাহানারার ফোন। বললো,মায়ের ঔষধ ফুরিয়ে গেছে সকালে। ঔষধ না কিনলে দুপুরে খেতে পারবেনা। বন্ধু রফিকদের ঔষধের দোকান আছে, বউরে বললাম ফোন করে দিচ্ছি তুমি গিয়ে ঔষধ নিয়ে এসো।ফোন কেটে দিয়ে পুনরায় কোচ-৭৫৭ ছেড়ে দিলাম। আপাতত যাত্রী ওঠা-নামার ঝামেলা শেষ,এবার সোজা ফেরিঘাট যেতে হবে। ওদিকে খোকন বলেই চলেছে ” ওস্তাদ বাঁ চাপে, বাম্পারে ওস্তাদ, বরাবর বরাবর, সিরিয়াল “। ডারবি ধরিয়ে সুপারভাইজার ইঞ্জিন কভারের উপর বসে, শাবুদ্দীন ভাই বাড়ির কি অবস্থা?
– এই মোটামুটি,জানিস তো মায়ের অসুখ, ছেলেটা ছোট। ( ও বেশ অনেকদিন ধরে আমার গাড়িতে আছে,এজন্য বাড়ি সম্পর্কে কিছুটা জানে)।
– ভাই,করোনা তো বাড়তেছে।লকডাউন পড়লে কি করবা?
– কি জানিহ
দুপুর ১২ঃ৩০ টায় ফেরিঘাটে পৌঁছে খোকনরে গাড়ি টানতে বলে কিছু খাওয়া দাওয়া সেরে পেছন সিটে গিয়ে রেস্ট নিলাম। ফেরি পার হয়ে গাবতলী পৌঁছাতে বিকাল ৫ টা বেজে গেল।
বউরে ফোন দিলাম,সারাদিনের খোঁজ নিলাম।
– বাড়ি আসার সময় বাবুর জন্য দুধ নিয়ে আইসো।আর মনে করে গাড়ি ছাড়ার আগে খেয়ে নিও।
– আচ্ছা ঠিক আছে, রাখি।
খেয়ে রাত ৮ টায় যথারীতি কাউন্টারে গাড়ি লাগিয়ে দিলাম। ২৫ জন যাত্রী নিয়ে ৮ঃ৩০ টায় শ্যামলী থেকে রওনা হলাম। এর মধ্যে এক যাত্রীর মা মারা গেছে, তাই বাড়ি ফিরছে। ইঞ্জিন কভারে বসেছিল বলে দু’টো কথা বলে সান্ত্বনা দিতে পারলাম।সান্ত্বনা দিয়েওবা কি লাভ,আসলে যার যায় সেই বোঝে।এরকম কতশত যাত্রী বাপ-মা-ভাই মারা যায়।
এদিকে খোকন বললো, ওস্তাদ পরশু থেকে লকডাউন পড়ছে ৭ দিনের।
– কি বলিস তুই?
– হ, ওস্তাদ। খবরে বলছে,আমি এফএমে শুনলাম।
– ( চিন্তার এক ঘনকালো আকাশ মাথায় ভেঙ্গে পড়লো)
– ও ওস্তাদ, কি ভাবেন?
– কিছু না রে।( সপ্তাহে ৩০০ টাকা সমিতির কিস্তি, বাবুর ৫০০ টাকার দুধ, মায়ের ২৫০ টাকার ঔষধ, সংসারের খরচ কিভাবে চলবে)
রাত ০১ঃ৩০ টা, ফেরিতে গাড়ি উঠলে চিন্তাকে দূরে রাখতে ইঞ্জিন কভারে গা এলিয়ে দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। এরপর সোজা শেষ গন্তব্য সাতক্ষীরা। গাড়ি কাউন্টারে রেখে বুকভরা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বাড়ির পথে চললাম।এর আগে ছেলের জন্য দুধ,বউয়ের জন্য কিছু জিনিস ও বাজার নিয়ে নিলাম।
মারে বললাম,মা একটু বেশি করে দোয়া করে দাও।জাহানারা ও জাহানারা…..
কোথায় গেলে… ওদিকে ছেলেটা ঘরে কাঁদছে। বাবু কাঁদছে,খেয়াল করো তাড়াতাড়ি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, খেয়ে একটু ঘুমাতে হবে গো।
পরদিন শুনলাম লকডাউন আরো বাড়বে… সাপ্তাহিক খরচের দুশ্চিন্তা মাথায় চেপে বসলো… এভাবে সপ্তাহ পার হয়ে গেল… আবার লকডাউন পড়লো… এরপর আবার যদি লকডাউন পড়ে তবে শিওর আবার ঋণ করতে হবে। এদিকে কোনো ত্রাণও মিলছে না।
এসব দুশ্চিন্তায় আল্লাহকে স্মরণ করেই বউরে বললাম রিজিকের মালিক তো আল্লাহ। তিনি যা ভাল মনে করেন; চিন্তা করো না জাহানারা, আল্লাহ ভরসা।
আমি শাবুদ্দীন।
আমি একজন পরিবহন শ্রমিক।
লেখক :
এ টি এম মাহফুজ
শিক্ষার্থী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
