যত অজানা কথা
বিশ্বতারকা ফুটবলার হামজা চৌধুরী এখন বাংলাদেশের নাগরিক, খেলবেন লাল-সবুজের জার্সিতে


বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নতুন বিশ্বতারকার আবির্ভাব। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হামজা চৌধুরী এখন বাংলাদেশের নাগরিক, খেলবেন জাতীয় ফুটবল দলে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দাপিয়ে বেড়ানো হামজা খেলবেন লাল-সবুজের জার্সিতে, ভাবতে নিশ্চয়ই শিহরণ জাগছে সমর্থকদের।
হামজা চৌধুরী এরই মধ্যে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। গেছেন দেশের বাড়ি হবিগঞ্জে। সেখানে রাজকীয়ভাবে বরণ করা হয়েছে হামজাকে।
হামজার বাবা গ্রেনাডিয়ান, মা বাংলাদেশি। তবে গ্রেনাডিয়ান বাবার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় তার মা রাফিয়া চৌধুরীর। পরে গোলাম মোর্শেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন হামজার মা। হামজা মায়ের কাছেই বড় হয়েছেন।
মায়ের সংস্পর্শে থেকেই বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে হামজা। এমনকি ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষাটাও পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকেই।
ফুটবলে হামজার হাতেখড়ি
ছোটবেলা থেকেই বেশ চঞ্চল ছিলেন দেওয়ান হামজা চৌধুরী। খেলাধুলার প্রতি তার ছিল বিশেষ ঝোঁক। বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতেন। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতেন। জীবনে কোনো খেলায় দ্বিতীয় হননি তিনি। মাত্র ৫ বছর বয়স থেকেই তার ফুটবল খেলা শুরু। খেলতেন পাড়ার ক্লাবে। ২০০৫ সালে ৭ বছর বয়সে মা-বাবা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী লেস্টার ক্লাবে। তখন থেকেই তার ফুটবলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। স্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি খেলাধুলার ওপর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ক্লাবেই খেলতে থাকেন নিয়মিত। টানা ২০ বছর ধরে তিনি এখানে খেলছেন। কুড়িয়েছেন অনেক সুনাম। বিশ্বজুড়ে তার খ্যাতি ছড়িয়েছে।
এসব বিষয় বলতে গিয়ে তার বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, একবার হামজা দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। কিন্তু তাকে দেওয়া হয় দ্বিতীয় পুরস্কার। তাই সে পুরস্কার নেয়নি। কারণ সে জানে যে প্রথম হয়েছে। তার জীবনে কোনো খেলায় সে দ্বিতীয় হয়নি। সবারই প্রথম হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৭ বছর বয়স থেকে সে লেস্টার ক্লাবের সদস্য। খেলা দেখে সেই ছোটবেলা থেকেই বহু ক্লাব থেকে তাকে নেওয়ার জন্য অফার এসেছে। কিন্তু আমরা রাজি হইনি। শুরু থেকেই লেস্টারে আছে। এখনো লেস্টারেই আছে। এখানেই তার ফুটবলের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি।
সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে হামজা
হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার স্লানঘাট গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার দেওয়ান বাড়ির সন্তান হামজা। জেলাজুড়ে এ বাড়ির খ্যাতি রয়েছে ব্যাপক। এখানে যেমন জন্মেছেন পীর মাশায়েখ, তেমনি জন্মেছেন অনেক গুণীজন। শিক্ষাবিদ, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবই আছেন এ বাড়িতে। এবার যুক্ত হয়েছেন বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো ফুটবল খেলোয়াড়ও।
দেওয়ান হামজা চৌধুরীর জন্ম বেড়ে ওঠা সবই ইংল্যান্ডে। পিতা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ। মাতা রাফিয়া চৌধুরী। মাত্র দেড় বা ২ বছর বয়সে ২০০০ সালে প্রথমবার দেশে আসেন। এরপর এসেছেন বেশ কয়েকবার। ২৭ বছর বয়সী এ যুবক ইতিমধ্যে ফুটবলের বরপুত্র হিসেবে বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছেন। খেলেন লেস্টার ক্লাবে। মাত্র ৭ বছর বয়স থেকে এ ক্লাবেই তার ফুটবলের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি শুরু। টানা ২০ বছর ধরে একই ক্লাবে খেলছেন।
দেশে এসেছেন বহুবার। কিন্তু এবারের আসা ভিন্ন। এবার তিনি এসেছেন নিজ দেশের হয়ে খেলতে। তাই এলাকাবাসীর মধ্যে আনন্দের ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। সাথে এসেছেন বিদেশি স্ত্রী ও সন্তানরা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এটি হামজার প্রথম বাংলাদেশ সফর। তাই বিষয়টি আরও আনন্দিত করে তুলেছে মানুষজনকে। সোমবার সকাল ১১টায় তিনি মা ও স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখেন। বাড়ি পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে যায়। অপেক্ষার শেষ নেই উৎসুক জনতার মাঝে। তবুও কারও মাঝে কোনো ক্লান্তি ছিল না।
হামজাকে নিয়ে যত স্বপ্ন দেশবাসীর
এবার দেওয়ান হামজা চৌধুরীর দেশে আসা শুধুই নিজ বাড়িতে বেড়ানোর জন্য নয়। এবার এসেছেন তিনি নিজ দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলতে। নিজ দেশকে নিয়ে বিশ্বকাপ আসরে খেলতে স্বপ্ন দেখছেন, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন দেশবাসীকেও। এ জন্য প্রাণভরে দোয়া করছেন এলাকাবাসী। মাদরাসা-মসজিদেও দোয়া হয়েছে।
হামজার হাত ধরেই এবার না হয়, পরের বিশ্বকাপ আসরে খেলবে প্রিয় বাংলাদেশ, এমন প্রত্যাশা তার শৈশবের সাথীদের। দেওয়ান হামজা চৌধুরীর শৈশবের খেলার সাথী আব্দুল আজিজ বলেন, ছোটবেলায় হামজা আমাদের সাথে পাড়ার মাঠে খেলেছে। তখনই আমরা মনে করতাম হামজা একদিন অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এখন আমরা বিশ্বাস করি হামজার হাত ধরেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি অচিরেই বিশ্বকাপ খেলবে।
মাদরাসাছাত্র আব্দুল মোমিন বলেন, দেওয়ান হামজা চৌধুরীর জন্য আমরা প্রাণভরে দোয়া করি। তিনি যেন আমাদের দেশকে নিয়ে একদিন বিশ্বকাপ আসরে খেলাতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করি তিনি আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ্।
ধর্মে অবিচল হামজা: খেলতে নামেন আয়াতুল কুরসি পড়ে
শৈশব থেকেই ধর্মের প্রতি অবিচল দেওয়ান হামজা চৌধুরী। নিজে নামাজ পড়েন। স্ত্রী অলিভিয়াও একজন ধর্মপ্রাণ নারী। হামজা ছোটবেলায় কোরআন শিক্ষা লাভ করেছেন ইংল্যান্ডের স্থানীয় একটি মাদরাসায়। সেখানেই তার ধর্মের তালিম নেওয়া। নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, ধর্মীয় রীতিনীতি সব মেনে চলেন। ঘর থেকে বের হলেই আয়াতুল কুরসি পড়েন। খেলতে নামার আগেও তিনি আয়াতুল কুরসি পড়েন। আল্লাহর প্রশংসা করে মাঠে নামেন তিনি। এ তথ্য জানিয়েছেন তার বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ।
তিনি বলেন, শৈশবে আমরা ছেলেকে মাদরাসায় পড়িয়েছি। সেখানে কোরআন শিক্ষা দিয়েছি। দ্বীনের শিক্ষা দিয়েছি। নামাজ পড়তে শিখিয়েছি। ঘর থেকে বের হলেই আয়াতুল কুরসি পড়তে হবে, খেলায় নামার আগে আয়াতুল কুরসি পড়তে হবে শিখিয়েছি। এগুলো সে নিয়মিতই পালন করে। একবারের জন্যও ভোলে না। তার স্ত্রী অলিভিয়া একজন ব্রিটিশ মুসলিম। কিন্তু সে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। নামাজ-রোজা ইসলামী রীতিনীতি সবই সে নিয়মিত পালন করে।
স্ত্রীর ইচ্ছায় এতিমখানা প্রতিষ্ঠা
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্লানঘাট গ্রামে নিজ বাড়িতে একটি এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন কৃতি ফুটবলার দেওয়ান হামজা চৌধুরী। স্ত্রী অলিভিয়ার ইচ্ছায়ই তিনি ২০২২ সালে এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বর্তমানে ৩০ জন ছাত্র কোরআনের হাফেজ হওয়ার জন্য পড়ছেন। শিক্ষক আছেন একজন। এতিমখানাটির পূর্ণ খরচ বহন করেন তিনি নিজের আয় থেকে। এ জন্য নিয়মিত টাকা পাঠান। মাদরাসার নামকরণ করেছেন বড় ছেলের নামে। নাম দিয়েছেন দেওয়ান ঈসা হুসাইন চৌধুরী হাফিজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা।
মাদরাসা সংলগ্ন রয়েছে বিশাল মাঠ। শিশুদের বিকশিত হওয়ার রয়েছে বিস্তর সুযোগ। মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, দেওয়ান হামজা চৌধুরীর বড় ছেলের নামে তিনি নিজে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এতিমদের দ্বীনি শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি এগুলো দেখাশোনা করেন। খরচ সবই তিনি নিজে বহন করেন। আমরা তার জন্য প্রাণভরে দোয়া করি তিনি যেন আরও বড় কিছু করতে পারেন। বাংলাদেশকে যেন তিনি বিশ্বকাপ ফুটবলে নিয়ে গর্বিত করতে পারেন।
হামজা চৌধুরীর বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, ২০২২ সালে ছেলেকে আমরা বিয়ে করাই। এরপর বৌমা বাংলাদেশে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা পোষণ করে। তখন আমি বাড়ির কিছু অংশ এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদরাসা করার জন্য দিই। এখানেই তারা এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠা করে। এখানে শিশুরা দ্বীনি শিক্ষা লাভ করছে। দিনরাত কোরআন তেলাওয়াত করছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না।
পছন্দের খাবার
বাঙালি খাবার হামজা চৌধুরীর বেশ পছন্দের। তিনি বাংলা খাবারের তালিকার মধ্যে মোরগ পোলাও বেশ পছন্দ করেন। এ তালিকায় রয়েছে ঘরোয়া পিঠা, পুলি। এর মধ্যে সন্দেশ (চালের গুড়ি বা ময়দা দিয়ে তৈরি এক ধরনের পিঠা), নারিকেলের পিঠা, সাজের পিঠা (ডিম ও ময়দা দিয়ে তৈরি এক ধরনের পিঠা)। তবে তার সবচেয়ে পছন্দের একটি খাবার বাংলাদেশে তৈরি বার্মিজ আচার। শৈশব থেকেই তিনি দেশে এলে এটি বেশি খেতেন।
হামজার পছন্দের খাবারের তালিকা দিতে গিয়ে চাচা দেওয়ান মাসুদ বলেন, হামজা ছোটবেলা থেকেই দেশে এলে বার্মিজ আচার খেতো। এটি তার খুব পছন্দের। তবে ঘরোয়া পিঠার প্রতি তার অন্যরকম ঝোঁক রয়েছে। তাই দু’দিন ধরে বাড়িতে মহিলারা তার জন্য পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সবার মাঝে যেন উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে।
হামজা চৌধুরীর বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ বলেন, হামজা ইংল্যান্ডে জন্ম থেকে বড় হলেও বাংলা খাবার বেশ পছন্দ করে। এর মাঝে তার সবচেয়ে পছন্দের খাবার মোরগ পোলাও। এটি তার স্ত্রীও বেশ পছন্দ করে।

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
