হেলিকপ্টার রুবেলের স্মার্ট প্রতারণা, শতাধিক পরিবার কাঁদছে
কুষ্টিয়ার খোকসায় স্মার্ট প্রতারণার শিকার শতাধিক দুস্থ পরিবারের ঘর নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাসস্থান হারিয়ে প্রতিবেশীদের ঘরে আশ্রয় নেয়া এসব পরিবারগুলো চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
গড়াই ও সিরাজপুর হাওড় নদীবেষ্টিত বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন। মোট জনসংখ্যা ১৫ হাজারের মতো। নদীভাঙন কবলিত এলাকায় উন্নয়নে ‘দূত’ হিসেবে সম্প্রতি হাজির হন প্রতারক চক্রের প্রধান রুবেল আহম্মেদ। নিজেকে একটি সাহায্য সংস্থার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পরিচয় দেন। হেলিকপ্টারে চলাফেরা করেন এই স্মার্ট প্রতারক। বিদেশিদের অর্থায়নে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের দুস্থদের আধাপাকা টিনশেড ঘর তুলে দেয়ার কাজ শুরু হয়। কিন্তু মাঝ পথে এসে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অধিক লাভজনক প্রকল্প পাইয়ে দেয়ার কথা বলে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
পরে কৌশলে সটকে পড়েন প্রতারক চক্রের প্রধান হেলিকপ্টার রুবেল। ফলে দুস্থদের পাকাঘর নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ করে দেন সংশ্লিষ্ট এলাকার মেম্বাররা। আর বাসস্থানহারা দুস্থরা পড়েন বিপাকে। এই শীতের মধ্যে প্রতিবেশীর ঘরের বারান্দায় আবার কেউ প্রতিবেশীর রান্নাঘরে কাপড় টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
ভুক্তভোগী কয়েকজন মেম্বার জানান, তিন মাস আগে এই রুবেল আহম্মেদ কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশল কো-অপারেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পরিচয় দিয়ে এক দালালের মাধ্যমে এলাকায় আসেন। বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন হেলিকপ্টার। বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবুল আখতারসহ পরিষদের মেম্বারদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। হাতে নেয়া হয় বনগ্রামে তিনটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, রিসোর্ট, আবাসন ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের উন্নয়নে হরেক রকম প্রকল্প। বসবাস শুরু করেন ইউনিয়ন পরিষদের ভবনে। নিয়োগ দেন দুই রাঁধুনিসহ প্রায় ৮ জন কর্মচারী।
জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের উন্নয়নে ওয়ার্ডের মেম্বারদের মাধ্যমে চাঁদট গ্রামে গড়াই নদীরভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা হয়। একই সময়ে ৭, ৮, ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১২০টি অসহায়-দুস্থদের গৃহনির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন ঘর নির্মাণের ধুয়ো তুলে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রুস্তম, ছকিরন নেছা, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্লভ, মজিদ, তমেজ, ছাইদুল, ওহাব, আতিয়ার, বুরো, আপিল, শাহিনের মতো শতাধিক দুস্থ পরিবারের মাথাগোঁজার শেষ আশ্রয় বসতঘর ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে এসব পরিবারের জন্য ১৫ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া দুই কক্ষের থাকার ঘর সঙ্গে রান্নার ঘর ও পাকা টয়লেট নির্মাণকাজ শুরু করা হয়।
বনগ্রাম পূর্বপাড়ায় বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল আখতারের নামে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য চড়া দামে জমি বায়না করা হয়। ইতোমধ্যে এই প্রতারক চক্র আরও দুইশো কোটি টাকার লাভজনক প্রকল্প পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে ভুক্তভোগী জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) সকালে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরের বনগ্রামে সরেজমিন গিয়ে কথা হয় বাসস্থানহারা বৃদ্ধ রমজান আলীর সঙ্গে। পাঁচ সন্তানের জনক বৃদ্ধের বসতঘর ভেঙে সেখানে আধাপাকা ঘর তৈরি শুরু করেছিলেন স্থানীয় মেম্বার সাইদুজ্জামান। প্রায় ৭ ফুট দেয়াল গাঁথাও হয়েছে। ঘর দেখতে এসেছিলেন চেয়ারম্যানসহ বিদেশি সাহেবরা। কিন্তু মাসখানেক ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যেই বৃদ্ধের সদ্যনির্মিত ঘরের একটি কক্ষের পেছনের দেয়াল ভেঙে পড়েছে। তিনি শুনেছেন বিদেশিরা পালিয়ে গেছেন। তাই তার ঘর আর তৈরি হচ্ছে না।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ে ও স্ত্রী সুন্দরী খাতুনকে নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে প্রতিবেশীর বারান্দায় কাপড় টাঙিয়ে বসবাস করছেন তিনি। ঘর পাওয়ার আশায় নিজে সেই পুরাতন ঘরটিও বিক্রি করে নতুন ঘরের মেঝেতে মাটি দিয়েছিলেন। কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধ। এখন তিনি কোথায় যাবেন, এই বিলাপই তার মুখে।
এই চক্রের খপ্পরে পড়েছেন বৃদ্ধা ছকিরন নেছা। একমাত্র বসতঘরটি ভেঙে সেখানে পাকাঘর নির্মাণ শুরু করেছিলেন একই ওয়ার্ডের মেম্বার। কিন্তু ঘর আর পাকা হয়নি। নিজের শূন্য ভিটায় বসে বিলাপ করছিলেন তিনিও। ঘর ভাঙার পর থেকে প্রায় দুই মাস ধরে এক প্রতিবেশীর ঘরে থাকছেন তিনি।
৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল মজিদ জানান, প্রতিটি বাড়ি নির্মাণের জন্য জন্য চার লাখ টাকা বরাদ্দের কথা শুনেছিলেন। তাদের দেয়া ডিজাইনে প্রতিটি বাড়ি তৈরিতে ব্যয় হওয়ার কথা ছিল তিন লাখ টাকার মতো। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের উন্নয়নে চার কোটি টাকার প্রকল্প পাইয়ে দেয়ার জন্য তার কাছ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক চক্রের প্রধান রুবেল আহম্মেদ। একইভাবে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বাবুল আখতার, থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম বাবুল, রাজু আহম্মেদ, ইটভাটার মালিক আব্দুল মজিদসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতারক হেলিকপ্টার রুবেল মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল আখতার বলেন, ‘এলাকার দুস্থ মানুষ সাহায্য পাবে— এমন ভরসায় তিনি সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রতারক রুবেল হেলিকপ্টারে যাতায়াত করতেন। তিনি যে প্রতারক হতে পারেন, এটা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। তিনি না বুঝে প্রতারক চক্রের প্রধান রুবেলকে টাকা দিয়েছেন। পরিষদের অন্য কেউ কেউ গোপনে তাকে টাকা দিয়েছেন বলে শুনেছেন। প্রতারণার ঘটনায় তিনি রাজধানীর একটি থানায় রুবেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সেই মামলায় প্রতারক রুবেল আটক ও রিমান্ডে আছেন।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)