রাশিয়ায় যে কৌশলে বারবার জয়ী হন পুতিন
যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের করা এ মন্তব্যই তার অবস্থানকেই প্রকাশ করছে। রাশিয়ায় এবার যে নির্বাচন তাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও পুতিন যেন একাই প্রার্থী এবং তিনিই বিজয়ী।
শুক্রবার সকালে রাশিয়ায় আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। দেশটির ১১টি টাইম জোনে এই ভোটগ্রহণ চলবে ১৭ মার্চ পর্যন্ত। ইউক্রেনে রাশিয়াকে যুদ্ধে জড়িয়েও দেশটিতে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছেন ৭১ বছর বয়সি পুতিন।
দক্ষিণ মস্কোর একটি বৃহত্তম পাইকারি বাজারে কেনাকাটা করতে আসা ৪৬ বছর বয়সি লিডমিলা পেত্রোভা বলেছেন, ‘আমি পুতিনের সমর্থক। অবশ্যই আমি তাকেই ভোট দেব।’
তিনি রয়টার্সকে বলেন, পুতিন রাশিয়াকে নতজানু অবস্থা থেকে নিজ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়েছেন। পশ্চিমা ও ইউক্রেনকে রাশিয়া পরাজিত করবে। রাশিয়াকে আপনারা পরাজিত করতে পারবেন না, কখনো না।’
এ সময় লিডমিলা আরও বলেন, ‘আপনারা পশ্চিমারা কি পাগল হয়ে গেছেন? ইউক্রেনের সঙ্গে আপনাদের কাজ কী?’
পশ্চিমাদের কাছে পুতিন একজন স্বৈরশাসক, একজন যুদ্ধাপরাধী, একজন খুনি। এমনকি গত মাসে পুতিনকে ‘ক্রেইজি এসওবি (সান অব অ্যা বিচ)’ বলেও মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, তার স্বৈরতন্ত্র রাশিয়াকে দাসত্বে পরিণত করেছে।
রাশিয়ায় করা একাধিক জনমত জরিপ ও দেশটির কয়েকটি সিনিয়র সূত্রের সাক্ষাৎকার অনুসারে, ইউক্রেনের যুদ্ধ রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পাশাপাশি তার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করেছে।
ক্রেমলিনের উচ্চপর্যায়ের এক সূত্র বলেছেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই, এটি জীবন পাল্টে দেওয়ার মতো একটি ঘটনা ছিল।’
রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি তার পরিচয় গোপন রাখার শর্ত দিয়েছেন ওই সূত্র।
রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, ‘পুতিনের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তিনি একেবারে অন্য উচ্চতায় চলে গেছেন। নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে রাশিয়াকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পশ্চিমার একটি মারাত্মক ভুল করেছে। এর মাধ্যমে দেশটির জনগণ এবং অভিজাত শ্রেণির একটি বিশাল অংশের মধ্যে আরও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি।
বিশেষ সামরিক অভিযান
আরেক সিনিয়র সূত্র বলেছেন, নেতা হিসেবে পুতিনের শাসনের মেয়াদ কোনো রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়; বরং তার স্বাস্থ্যগত বিষয়। তার স্বাস্থ্য বেশ সবল। বাস্তবিকই তার কোনো দৃশ্যমান উত্তরসূরি নেই।
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া সর্বাত্মক হামলায় চালায়, যেটিকে তারা ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নামে অভিহিত করেছিল। পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সঙ্গে রুশপন্থি ইউক্রেনীয় ও রুশ সমর্থিতদের মধ্যে আট বছরের সংঘাত শেষে এই সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া।
সর্বশেষ এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের হাজার হাজার সেনা নিহত ও আরও অনেক সেনা আহত হয়েছেন। এই যুদ্ধে ইউক্রেনের হাজার হাজার বেসামরিক হতাহতের পাশাপাশি তাদের অর্থনীতি ও অবকাঠামো কোটি কোটি ডলার মূল্যের ক্ষতির মুখে পড়েছে।
পশ্চিমারা ইউক্রেনে শত শত কোটি ডলার মূল্যের মানবিক ও সামরিক সহযোগিতা পাঠিয়েছে। পশ্চিমা নেতারা পুতিনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বৈশ্বিক প্রভাব পুনরুদ্ধারের জন্য ইউক্রেনে নৃশংস সাম্রাজ্যবাদী ধাঁচের যুদ্ধ পরিচালনার অভিযোগ করেছেন।
পশ্চিমাদের সঙ্গে যুদ্ধ
ইউক্রেনের যুদ্ধকে পুতিন ক্ষয়িষ্ণু পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে হাজির করছেন। তার দাবি, ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতনের পর পশ্চিমারা রাশিয়াকে অপদস্থ করেছে ইউক্রেনসহ তাদের বলয়ের দেশগুলোতে অনধিকার প্রবেশ করে।
পণ্য নয়, পশ্চিমাদের রাজনীতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহে থাকা রুশদের মধ্যে পুতিনের এই অবস্থানের আবেদন রয়েছে। ক্রেমলিনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে– যারা পুতিনের টিম হিসেবে পরিচিত, তারা প্রকাশ্যে ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধের কথা বলে আসছেন।
রুশ জরিপকারী লেভাডা সেন্টারের জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পূর্বে পুতিনের পক্ষে সমর্থন ছিল ৭১ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮৬ শতাংশ। ২০০৮ সালে জর্জিয়া ও ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের সময়ও পুতিনের জনপ্রিয়তা বেড়েছিল।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণায় পুতিনকে একজন দেশপ্রেমী হিসেবে তুলে ধরা হয়। বিপরীতে বাইডেনের মতো পশ্চিমা নেতাদের দুর্বল, বোকা ও ধূর্ত হিসেবে হাজির করা হচ্ছে।
লেভাডার আর্থসামাজিক গবেষণার প্রধান আলেক্সেই লেভিনসন বলেন, অনেক রুশ নাগরিক, যারা রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় অনুপ্রাণিত, তারা মনে করেন পশ্চিমাদের সঙ্গে পুরনো লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে রাশিয়া। এখন যা ঘটছে তা সেই লড়াইয়ের একটি পর্যায়।
তিনি আরও বলেছেন, আমাদের জরিপে যারা এমন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তারা নিজেদের পশ্চিমাদের সঙ্গে এই লড়াইয়ে কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণকারী হিসেবে বিবেচনা করেন। তারা হলেন ফুটবলের সেই সমর্থকদের মতো, যারা কল্পনা করেন তারা খেলায় অংশগ্রহণ করছেন।
যুদ্ধ নিয়ে সন্দেহে থাকা রুশ অভিজাতদের অনেকেই মনে করেন, ক্রেমলিনের বিরোধিতা করে তাদের লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি। যেমনটি ২০২৩ সালে রুশ ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের ব্যর্থ বিদ্রোহে দেখা গেছে।
বিদ্রোহের দুই মাস পর ২৫ আগস্ট প্রিগোজিনকে বহনকারী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। বিরোধীদের কোনো সুযোগ দেন না পুতিন। ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণের পর যে কোনো ভিন্নমত দমনে অভিযান চালিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যুদ্ধের বিরোধিতা করায় শত শত মানুষকে কারাবন্দি এবং বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
রাশিয়ায় সম্প্রচারে আধিপত্য রয়েছে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের এবং তা কট্টর পুতিন সমর্থক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে তিন প্রার্থী রয়েছেন তাদের কাজই হলো পরাজিত হওয়া। তাদের কারও সমর্থন ৬ শতাংশের বেশি নয়।
যুদ্ধবিরোধী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়তে চাওয়া বরিস নাদেজদিনকে এক নির্বাচনি কর্মকর্তা বলেছিলেন, তার উচিত অভিযোগ না করে নিজের ঘাটতির দিকে মনোযোগ দেওয়া। প্রার্থী হওয়ার জন্য হাজার হাজার ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহ করলেও তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
ছয়টি সূত্র বলেছে, ক্রেমলিনের প্রধান উদ্বেগের বিষয় ভোটার উপস্থিতির উচ্চ হার নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কোম্পানির কর্মকর্তারা কর্মীদের ভোট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের ব্যালটের সঙ্গে ছবি জমা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এমনকি এটিএম বুথগুলোতে রুশদের ভোট দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাশিয়ার বিভক্ত বিরোধী রাজনীতিকরা হয় বিদেশে কিংবা কারাগারে, নীরব অথবা মৃত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিরোধী নেতা আলেক্সেই নাভালনি ১৬ ফেব্রুয়ারি কারাগারে মারা গেছেন। তার বিধবা স্ত্রী ইউলিয়া রুশদের ১৭ মার্চ দুপুরে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে বিরোধিতা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন।
পুতিন দুর্বল না শক্তিশালী— এমন প্রশ্নের জবাবে নাভালনির এক শীর্ষ সহযোগী লিওনিদ ভলকভ বলেছেন, নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগে ডাইনোসররা খুব শক্তিশালী ছিল।
লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াসে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলার পর হাতুড়ি হামলার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। ক্রেমলিন এ ঘটনায় কোনো মন্তব্য করেনি।
রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে অপমান করার দায়ে আড়াই বছরের কারাদণ্ড পাওয়া প্রবীণ রুশ মানবাধিকারকর্মী ওলেগ ওরলভ পুতিনের রাশিয়াকে তুলনা করেছেন ফ্রানজ কাফকা ও ভ্লাদিমির সরোকিনের উপন্যাসের সঙ্গে।
ওরলভ বলেছেন, যারা আমাদের দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে গর্তে নিয়ে গেছেন, তারা এখন পুরনো, জরাজীর্ণ ও অপ্রচলিতকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধারণা নেই। তাদের রয়েছে অতীতের মিথ্যা চিত্র, রয়েছে সাম্রাজ্যিক মহত্ত্বের মরীচিকা। তারা রাশিয়াকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, ডিস্টোপিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
রক্ত ও প্রাচুর্য
ইউক্রেনের এই যুদ্ধে হাজার হাজার রুশ সেনাও নিহত হয়েছেন। রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্বল্প সময়ে যুদ্ধ জয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২২ সালের সেনা সমাবেশের ঘোষণাতে রুশ জনগণের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ ছড়ায়।
তবে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত রাশিয়ার অর্থনীতিকে ডুবাতে পারেনি। পুতিন সফলভাবেই শত শত রুশ সেনাকে চুক্তির আওতায় আনতে সফল হয়েছেন। একই সঙ্গে পরাশক্তি চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের অগ্রগতিও করেছেন।
সরকারি তথ্য অনুসারে, রাশিয়া যুদ্ধকেন্দ্রিক অর্থনীতি গত বছর ৩.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ৭.৮ শতাংশ। তবে দেশটিতে শ্রম সংকট, বিনিয়োগ ঘাটতি এবং জনসংখ্যা হ্রাসের মতো সংকট দেখা দিয়েছে।
তিন রুশ সূত্রের মতে, পুতিন বিশ্বাস করেন, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ও প্রভাব রয়েছে রাশিয়ার এবং আরও কয়েক বছর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রুশ সূত্র বলেছেন, একটি দেশের অর্থনীতির জন্য স্বল্প পরিসরের যুদ্ধ অবশ্য মন্দ কিছু নয়। পুতিন যতদিন ইচ্ছা ততদিনই যুদ্ধ করতে পারবেন।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)