চামড়া সস্তা, জুতা কেন নয়
পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানি দেওয়া লাখ টাকা দামের গরুটির চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে সাড়ে তিন শ টাকায়। শুধু এ বছর নয়, গত বছরও ছিল একই চিত্র। কিন্তু বিপণিবিতানে মোটামুটি পছন্দসই এক জোড়া জুতা কিনতে তিন হাজার টাকা লেগে যাচ্ছে।
বেসরকারি চাকরিজীবী নাজমুল হোসেনের ক্ষোভ এখানেই। তাঁর প্রশ্ন, চামড়া পানির দরে বিক্রি হলে জুতার দাম কেন কমবে না? এই লেখায় সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। দেখা হয়েছে, সস্তা চামড়ার সুযোগ নিয়ে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী ও বিক্রেতাদের মুনাফা কতটা বেড়েছে।
আগে কিছু সাধারণ তথ্য জেনে নিন। এবার এক লাখ টাকায় যেসব গরু বিক্রি হয়েছে, তার চামড়ার আয়তন ২৫ থেকে ৩০ বর্গফুট হতে পারে। যদি চামড়াটি ৪০০ টাকায় বিক্রি করেন, তাহলে প্রতি বর্গফুটের দাম পেয়েছেন ১৫ টাকার আশপাশে। চামড়াটি কয়েক দফা হাতবদল ও লবণের মূল্য যোগ হওয়ার পর ট্যানারিতে যেতে যেতে দাম বর্গফুটপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকায় ঠেকেছে।
চামড়া প্রক্রিয়াকরণের তিনটি ধাপ। ওয়েট ব্লু, ক্রাস্ট ও ফিনিশড। লেদার টেকনোলজিস্ট ফিরোজ আলম তালুকদার বলেন, এক বর্গফুট চামড়া তিন পর্যায়ে প্রক্রিয়া করতে মোট ৩৫ থেকে ৬০ টাকা ব্যয় হয়। এত ব্যয়ের কারণ রাসায়নিকের পেছনে খরচ। চামড়ায় ৩০ থেকে ৪০ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়। আবার একটি ট্যানারি কোন মানের চামড়া উৎপাদন করবে, তার ওপর ব্যয় নির্ভর করে।
বর্তমান দামে জুতার উপরিভাগের জন্য মোটামুটি ভালো মানের চামড়া তৈরি করতে খরচ বর্গফুটপ্রতি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। আর জুতার ভেতরে ব্যবহারের জন্য সাধারণ চামড়ার পেছনে বর্গফুটপ্রতি খরচ ৩৫ টাকার মতো। এরপর ট্যানারির শ্রমিক, প্রশাসনিক ব্যয়, ঋণের সুদ ও অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে মুনাফা যোগ করে চামড়ার দাম দাঁড়াবে।
তিন হাজার টাকা দামের একটি জুতার উৎপাদন ব্যয় কত, তা জানতে চেয়েছিলাম দুটি ব্র্যান্ডের কাছে। তারা যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায়, উৎপাদন খরচ মূলত ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে থাকে, যা মোট দামের ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে চামড়ার ব্যয় মোটামুটি ২৫০ টাকা। এই ব্যয়ের মধ্যে আবার একেবারে কাঁচা অবস্থায় চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা। তার মানে হলো কাঁচা চামড়ার দাম অর্ধেকে নামলেও জুতার মোট দামে প্রভাব খুব সামান্য। উল্লেখ্য, এক জোড়া জুতা তৈরিতে দুই থেকে সোয়া দুই বর্গফুট চামড়া লাগে।
চামড়ার পাশাপাশি জুতা তৈরিতে সোল, কাপড়, অ্যাকসেসরিজ (উপকরণ) ও আঠা লাগে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমদানি করতে হয়।
জানতে চাইলে বে ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমান বলেন, জুতার মূল ব্যয়টি আসলে বিপণন ও শোরুম খরচে। বাংলাদেশে শোরুমের ভাড়া ও অগ্রিম জমা অনেক বেশি। তিনি বলেন, চামড়ার দাম কমলেও মজুরি-বেতন, জ্বালানির দাম, ভাড়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে খরচ বাড়ছেই।
দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে নানা বিষয় বিবেচনায় নিতে হয় বলে জানান জিয়াউর রহমান। তাঁর দাবি, বড় ব্র্যান্ড যে পরিমাণ জুতা বিক্রি করে, তার মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ চামড়ার। এ জন্য লাভের পরিমাণ একটু বাড়িয়ে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে একটি ব্যবসাকৌশল হলো, চামড়ার জুতার দাম একটু বাড়িয়ে ধরা। আর তুলনামূলক কম আয়ের মানুষের বাজার ধরতে কম দামি পণ্যের মার্জিন (লাভের হার) কমিয়ে ধরা। এর কারণ, যারা চামড়ার জুতা কেনে, তাদের ক্ষেত্রে দাম কিছুটা বেশি হলেও তেমন প্রভাব পড়ে না।
আরেকটি বিষয় হলো, একটি মডেলের জুতা তৈরির পর অনেক ক্ষেত্রেই ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ অবিক্রীত থাকে। সেই জুতা বিশেষ ছাড় দিয়ে বিক্রি করতে হয়। একসময় কেজি দরে বিক্রি করে দিতে হয়। সারা পৃথিবীতেই ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো এটি বিবেচনায় নিয়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে।
দাম বেশি কেন, সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের নানা অজুহাত থাকতেই পারে। দেখতে হবে, জুতা ব্যবসায়ী কোম্পানির মুনাফা পরিস্থিতি কী।
এ ক্ষেত্রে আমরা দেশের জুতার বাজারে শীর্ষস্থানীয় দুই কোম্পানি বাটা শু বাংলাদেশ ও অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের আয়-ব্যয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করেছি। তারা পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানি। হিসাব তাদের ওয়েবসাইটেই রয়েছে।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৭৫৮ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করছে। মোট লাভ বা গ্রস প্রফিট ২৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা চামড়ার দামে পতন হওয়ার আগে (২০১৭-১৮ অর্থবছরে) ২১ শতাংশের মতো ছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, অ্যাপেক্সের মোট লাভের হার কিছুটা বেড়েছে। মোট লাভ থেকে কোম্পানিকে বিপণন ও প্রশাসনিক ব্যয় করতে হয়। সরকারের করও দিতে হয়। সেদিকে তাকালে দেখা যাবে, পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে অ্যাপেক্সের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল সাড়ে ১১ টাকার মতো। সেটা সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের হিসাবে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৫ টাকা ১৮ পয়সায় নেমেছে। মানে হলো, চামড়ার দাম কমলেও অ্যাপেক্সের শেয়ারপ্রতি আয় কমছে।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বাটার বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৬৪ কোটি টাকা। মোট লাভ বা গ্রস প্রফিট সাড়ে ৪৩ শতাংশ। ২০১৬ সালে চামড়ার দাম যখন ভালো ছিল, তখন বাটার মোট লাভের হার ছিল ৪০ শতাংশ। এর মানে হলো, চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় বাটার মোট লাভ অনেক বেড়ে গেছে, তা নয়। বরং ইপিএস পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।
যেমন করোনার আঘাত আসার আগে চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বাটার ইপিএস দাঁড়িয়েছে দুই টাকার কিছু বেশি। গত বছর তা ছিল তিন টাকার বেশি। এর আগে কয়েক বছরে আলোচ্য প্রান্তিকে ইপিএস কয়েক গুণ বেশি ছিল।
ভালো নেই চামড়া রপ্তানিকারকেরাও। কয়েক বছর ধরে রপ্তানি আয় ধারাবাহিকভাবে কমছে। এটি ছিল দেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় শীর্ষ খাত। এখন চামড়া চার নম্বরে নেমে গেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ডলারের বেশি। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৮০ কোটি ডলারে নেমেছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, লাভ অনেক বেশি হতো, তাহলে চামড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগত। কিন্তু কেউ তো চামড়া কেনায় ততটা আগ্রহ দেখাল না। তিনি বলেন, ‘আমরা কত দরে চামড়া বিক্রি করি, সে হিসাব সরকারের কাছে আছে। বড় কথা হলো, চামড়ায় অনেক মুনাফা হলে ট্যানারিগুলোর বেশির ভাগ খেলাপি হতো না।’
সর্বশেষ খবর হলো, করোনাকালের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) বাটা লোকসানে গেছে। অ্যাপেক্সের হিসাব এখনো আসেনি। আরেকটি শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড তাদের ১২টি শোরুম গুটিয়েছে।
সুত্র প্রথম আলো
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)