হার্টে ব্লক কেন হয়, যা করতে পারেন


হার্টের সুরক্ষা সবচেয়ে জরুরি। ধমনীতে ব্লক নানা কারণে হয়ে থাকে। বুকের বাম পাশে এক ধরনের ব্যথা অনুভব হলে বুঝতে হবে হার্টে সমস্যা হয়েছে।
হার্টের ধমনীতে ব্লক হওয়ার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার।
ব্লক কী
আমাদের সারা দেহে ছড়িয়ে আছে দুই ধরনের রক্তনালি- ধমনী ও শিরা। ধমনীর কাজ হল অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়া। ধমনীর প্রবাহপথ কোন কারণে সরু বা বন্ধ হয়ে গেলে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, এই বাধাকে বলে ‘ব্লক’ (ইষড়পশ)।
ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজ কী
হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীর নাম ‘করোনারি ধমনী’। এ করোনারি ধমনীতে ব্লক সৃষ্টি হলে তাকে বলে ‘ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজ’।
ব্লক কেন হয়
ধমনীতে ব্লকের মূল কারণ কোলেস্টেরল যা আমাদের প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে এবং রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে ধমনীর ভেতরের গায়ে জমা হয়ে ব্লকের সৃষ্টি করে। কোলেস্টেরলই ব্লকের একমাত্র কারণ নয়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং ধূমপানকেও বড় কারণগুলোর অন্যতম মনে করা হয়।
ব্লক কীভাবে বুঝবেন
করোনারি ধমনীতে ব্লক থাকলে নিচের উপসর্গগুলো দেখা যায়-
বুকের বামপাশে বা মাঝখানে এক ধরনের ব্যথা বোধ হয়।
অনেক সময় বাম হাতের ভেতরের দিকে অস্বস্তি বোধ হয়।
নিচের চোয়ালে বা দাঁতের পাশেও এক ধরনের অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে।
প্রাথমিক অবস্থায় কেবল শারীরিক পরিশ্রমের সময় এই ব্যাথা অনুভূত হয় এবং বিশ্রাম নিলে কমে যায়। মনে রাখতে হবে যে, ব্লক থাকলেই যেসব সময় ব্যাথা হবে, এমন নয়।
ব্লক থেকে হার্ট অ্যাটাক
ব্লক থাকলে নিয়মিত চিকিৎসা না নিলে তা হার্ট অ্যাটাকের দিকে মোড় নিতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃৎপেশি মারা যেতে শুরু করে বলে বুকে তীব্র ব্যথার সঙ্গে বমি ও প্রচুর ঘাম হয়। হার্ট অ্যাটাক ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজের খুবই মারাত্মক এক পরিণতি যা প্রায়ই রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক
যারা দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় বুকে তীব্র ব্যথা, ঘাম, বমি- এসব লক্ষণ ছাড়াই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। একে বলে ‘সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক’।
ব্লকের চিকিৎসায় কী করবেন
ব্লক যতই বিপজ্জনক হোক না কেন, জটিল আর দশটি রোগের মতো এরও চিকিৎসা রয়েছে, প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধের মাধ্যমে ব্লকের চিকিৎসা সম্ভব। মারাত্মক ব্লকের ক্ষেত্রে প্রথমে অ্যানজিওগ্রাম পরীক্ষা করে ব্লকের স্থান ও তীব্রতা নির্ধারণ করতে হবে। তারপর সম্ভব হলে কাঁটাছেঁড়া ছাড়াই রিং বসিয়ে ব্লক দূর করার চেষ্টা করতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এ পদ্ধতির নাম পারকিউটেনিয়াস করোনারি অ্যানজিওপ্লাস্টি সংক্ষেপে পিসিআই। ব্লক যদি সংখ্যায় বেশি হয়, রিং বসানো সুবিধাজনক নাও হতে পারে, সেক্ষেত্রে বাইপাস অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।
প্রাইমারি পিসিআই
আমাদের দেশে হার্ট অ্যাটাকের পরও অধিকাংশ রোগী দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না। সব জায়গায় হার্টের চিকিৎসার সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতাল ও নেই। তবে যদি দু’চার ঘণ্টার মধ্যেও রোগীকে হার্টের আধুনিক চিকিৎসার সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতালে আনা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যানজিওগ্রাম ও অ্যানজিওপ্লাস্টি করে ব্লক দূর করা যায়। এ পদ্ধতিকে বলে প্রাইমারি পিসিআই। বাংলাদেশের কিছু কিছু হাসপাতালে প্রাইমারি পিসিআই সুবিধা চালু হয়েছে। প্রাইমারি পিসিআই করা গেলে হার্ট অ্যাটাকের কারণে হৃৎপেশির সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়।
ব্লকমুক্ত হার্ট! কীভাবে
ধমনীর ভেতরের দেয়ালে চর্বি জমা হওয়ার পেছনে কারণ মূলত ৪টি;
-উচ্চ রক্তচাপ
-ডায়াবেটিস
-ধূমপান
-রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
সুতরাং, হার্টকে ব্লকমুক্ত রাখতে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ও ধূমপান পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি। কাজটি খুব সহজ নয়। এজন্য চাই দৃঢ় মনোবল এবং জীবনাচরণে পরিবর্তন। পুরো ব্যাপারটা কঠিন মনে হলেও জীবনাচরণ সংক্রান্ত কিছু কাজ কিন্তু সহজেই সম্ভব। যেমন-
শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানো
বাংলাদেশ যত নগরকেন্দ্রিক হচ্ছে, শহুরে লোকজন তত মানসিক যোগ্যতা নির্ভর হয়ে উঠছেন। তারা যতটা মাথা খাটাচ্ছেন, শরীর ততটা না। ফলে শরীর হয়ে পড়ছে নিষ্ক্রিয়। অথচ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকি কমায়।
লিফট কম ব্যবহার করুন
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা কিংবা জগিংয়ের অভ্যাস করুন। যারা হাঁটার সময় বের করতে পারেন না, তারা কাছের দূরত্বগুলো যানবাহন ব্যবহার না করে পায়ে হেঁটে যান। যতটা সম্ভব লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
ক্যালরির হিসাব রাখুন
খাবারের মাধ্যমে প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি আপনি গ্রহণ করছেন, সেই পরিমাণ ক্যালরি যদি খরচ না হয়, তাহলে বাড়তি ক্যালরি রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ওজন বাড়িয়ে আপনাকে ডায়াবেটিস ও ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজের দিকে ঠেলে দেবে। এজন্য প্রতিদিন খাবারের মাধ্যমে গৃহিত ক্যালরি ও এর ব্যয় সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা মাথায় রাখা ভালো।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি কমাতে নিচের খাবারগুলো আপনার দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন।
-টাটকা শাকসব্জি, ফলমূল
-মাছ- বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ
-বিভিন্ন ধরনের বাদাম (নাটস্), শিম, মটরশুঁটি
-সয়াজাত খাবার যেমন-তফু
-রসুন
-ননিমুক্ত দুধ, পনির
কিছু খাবার পরিহার করাও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের অংশ। এ ধরনের কিছু খাবার হল;
-অতিরিক্ত লবণ
-লাল মাংস ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস যেমন- গরু, খাসি, হাঁস ইত্যাদি
-মাংসের ওপরের চামড়া
-মাখন
-অধিকাংশ কোমল পানীয়
-অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার
সাধারণত কোন দাওয়াতে বা অনুষ্ঠানে গেলে খাদ্যগ্রহণের পরিমাণের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, কী খাচ্ছেন প্রশ্নটা যেমন জরুরি, কতটুকু খাচ্ছেন প্রশ্নটাও সমান জরুরি।
ডিম খাবেন নাকি খাবেন না
ডিম নিয়ে অনেকেই ঝামেলায় থাকেন। ডিম সাংঘাতিক পছন্দ, কিন্তু ডাক্তার খেতে নিষেধ করেছেন বলে খেতে পারছেন না, এমন মানুষ অসংখ্য। ডিম রক্তে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দিয়ে ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়- এ ধারণা থেকে সরে আসছে ইদানীংকার বিজ্ঞান। মনে রাখতে হবে লিপিড বা কোলেস্টেরল এমন একটা জিনিস যা আমাদের কোষের গঠন থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন গঠনগত ও শারীরবৃত্তিক প্রয়োজন মেটায়। বিভিন্ন হরমোন তৈরিতেও লিপিড দরকার হয়। একটা ডিমের কুসুমে যে পরিমাণ কোলেস্টেরল থাকে, তা আমাদের শরীরের দৈনন্দিন ক্ষয় মেরামতের জন্য প্রয়োজন। ডিমে অন্যান্য অনেক দরকারি পুষ্টি উপাদানও রয়েছে। তবে হ্যাঁ, কোন কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়, ডিমের ক্ষেত্রেও সে কথা প্রযোজ্য।
ভোজ্যতেল
রান্নায় তেলের ব্যবহার নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত। কোন তেলটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো- এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই অধিকাংশ মানুষের। ভোজ্যতেলের মধ্যে ‘ফ্যাট’ বা চর্বি থাকে। তবে এ ফ্যাটেরও ভালোমন্দ আছে। অসম্পৃক্ত চর্বি হার্টের জন্য ভালো, সম্পৃক্ত চর্বি খারাপ। তাহলে আমাদের বেছে নিতে হবে এমন তেল যাতে অসম্পৃক্ত চর্বি বেশি থাকে, সম্পৃক্ত চর্বি কম থাকে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শ মোতাবেক হৃদবান্ধব ভোজ্যতেলের একটা তালিকা এখানে দেয়া হল।
-ক্যানোলা
– কর্ন
-জলপাই
-বাদাম
– সানফ্লাওয়ার
-সয়াবিন
-সূর্যমুখী
উপরের তালিকার তেলগুলোর বিভিন্ন মিশ্রণ অনেক সময় ‘ভেজিটেবল ওয়েল’ নামে বাজারে পাওয়া যায়। সমস্যা হল এ তালিকার সবগুলো তেল আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়, অনেকগুলোর দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আজকাল বাজারে বাড়তি পুষ্টিগুণ যেমন- ওমেগা ৩ ও ৬ সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল পাওয়া যায়।
তামাককে ‘না’ বলুন
সিগারেটের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য যেমন- গুল, জর্দা ইত্যাদি গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। ‘পরোক্ষ ধূমপানে’র ব্যাপারেও সতর্ক থাকুন। ‘পরোক্ষ ধূমপান’ হল যখন আপনার পাশে কেউ ধূমপান করছেন তখন পরোক্ষভাবে আপনারও ধূমপান হয়। এটাও ক্ষতিকর, সুতরাং এ ধরনের ধূমপান থেকেও দূরে থাকুন।
মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকার অভ্যাস করুন
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ আপনার রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। সুতরাং যতটা সম্ভব মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। বুক ভরে শ্বাস নিন এবং সুযোগ পেলেই হাসুন, প্রাণখুলে। মানসিক প্রশান্তির জন্য নামাজ, প্রার্থনা, মেডিটেশন এসবের সাহায্যও নিতে পারেন।
নিয়মিত চেক-আপ
হার্টের ব্লক সাধারণত বয়স্কদের রোগ হলেও ইদানীং অল্প বয়সেও এ রোগ দেখা যাচ্ছে। তাই ব্লকজনিত হৃদরোগ বা ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজ প্রতিরোধে ৪০ বছর বয়সের পর নিয়মিত চেক-আপ করানো ভালো।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)

একই রকম সংবাদ সমূহ

আহমাদুল্লাহর আবেগঘন পোস্ট
জনপ্রিয় আলেম ও ইসলামি আলোচক শায়খ আহমাদুল্লাহ ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন। পোস্টেবিস্তারিত পড়ুন

পরিবেশগত হুমকির মুখে শহরগুলো
পরিবেশগত হুমকির মুখে শহরগুলো জোবায়ের ইসলাম জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং প্রাকৃতিকবিস্তারিত পড়ুন

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা চূড়ান্তের পথে
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ করছেবিস্তারিত পড়ুন