করোনাকালে ঋণে জর্জরিত নিম্নবিত্তরা
দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারী। তবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কাজ হারিয়ে সীমিত সঞ্চয় শেষ তারা এখন ঋণে জর্জরিত। প্রতিনিয়ত তাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে জীবনের সঙ্গে। বিশেষ করে শহুরে বস্তিবাসীদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ।
বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা বলছে, করোনার কারণে গত এক বছরে মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ কাজ হারিয়ে দরিদ্রের মাঝে নিপতিত হয়েছে। কর্মহীন হয়েছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। চলমান করোনায় আরো প্রায় চার কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি)-র যৌথ গবেষণা বলছে, শহুরে বস্তির মানুষ করোনা মহামারীর আগের অবস্থার চেয়ে বর্তমানে আয় কমেছে ১৪ শতাংশ। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত তিন ধাপে করা এই গবেষণা/জরিপ পরিচালিত হয় টেলিফোনের মাধ্যমে।
জরিপে কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্যের গতিপ্রকৃতি এবং স্বল্পআয়ের মানুষদের মাঝে এর প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) অনলাইনে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন পিপিআরসি-র নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডি-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে হত-দরিদ্র এবং মাঝারি দরিদ্রশ্রেণির মানুষের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। এছাড়া দরিদ্র নয় কিন্তু ঝুঁকিতে থাকা একশ্রেণির মানুষ রয়েছেন যাদের বলা হচ্ছে ভালনারেবল নন পুওর বা ভিএনপি। এই শ্রেণির মানুষকে সাধারণত দারিদ্র্যসীমার ওপরে কিন্তু মধ্যম জাতীয় আয়সীমার নিচে বলে গণ্য করা হয়। করোনার থাবায় এই শ্রেণির মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে তাদের অবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে সবচেয়ে ধীরগতিতে।
গত জুনে দরিদ্র নয় কিন্তু সেই ঝুঁকিতে থাকা এই মানুষদের ৭২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল। তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘নতুন দরিদ্র’ হিসেবে। সেই ‘নতুন দরিদ্র’দের ৫০ শতাংশ এখনও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের তালিকায় বিদ্যমান। এই হার শহরে ৫৯ শতাংশ এবং গ্রামে ৪৪ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ‘নতুন দরিদ্র’দের এই হার বিগত বছরের জুনে ছিল ২১ দশমিক ২ শতাংশে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যদিও কোভিডকালে সামাজিক সুরক্ষা নামমাত্র ভূমিকা পালন করছে কিন্তু এটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। শহরের দরিদ্রশ্রেণি এবং নতুন দরিদ্রদের জন্য বর্তমানে থাকা সুরক্ষা কর্মসূচির পাশাপাশি কার্যকরী ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন ও তাৎপর্যপূর্ণ আরো কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘নতুন আয়ের ধাক্কা সামলাতে স্মার্ট লকডাউন দরকার। এটি স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারও বটে।’
ড. হোসেন জিল্লুর দারিদ্রের ফাঁদে পড়া নারী ও নতুন দরিদ্রদের সহায়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, সিএসএমই-সহ অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়া খাতগুলোতে একটি পরিকল্পিত এবং জোর ধাক্কা দেওয়া প্রয়োজন। শুধু তাই নয়; অতিদ্রুত একটি জাতীয় সিএসএমই পুনরুদ্ধার কর্মসূচি প্রণয়নেরও আহ্বান জানান তিনি।
গবেষণায় বলা হয়, গতবছর ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ বস্তিবাসী শহর ছেড়েছিল যাদের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এখনও ফেরেনি। প্রাক-কোভিড অবস্থার তুলনায় আয় কমলেও খাবারের ব্যয় বাদে দৈনন্দিন যে ব্যয় সেটি গত জুন থেকে দ্বিগুণ হয়েছে। ভাড়াবাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রদের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমে গেছে আশ্চর্যজনকভাবে।
ভিএনপি এবং দরিদ্র নয় এমন শ্রেণির মানুষদের সঞ্চয়ের পরিমাণ কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। একইসাথে সব শ্রেণিতেই ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
যদিও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিগত জুন মাস থেকে উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তারপরও কোভিডের পূর্বে কাজ ছিল কিন্তু এখন বেকার এমন মানুষ রয়েছে ৮ শতাংশ। কর্মহীনতার এই ধারা নারীদের জন্য বেশ আশংকাজনক। কোভিডের আগে কর্মজীবী ছিলেন এমন নারীদের এক-তৃতীয়াংশ গত বছর জুন মাস থেকে এখনও বেকার। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার নেমে এসেছে ১৬ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে।
এদিকে, অতি সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার মধ্যে এ পর্যন্ত ১ কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। নতুন করে লকডাউন শুরু হওয়ায় কর্মহীন মানুষের তালিকা আরো দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
ড. আবুল বারাকাতের গবেষণায় দেখানো হয়-দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষের মধ্যে শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছে সেবা খাতে।
ড. আবুল বারাকাত বলেন, ‘এক্ষেত্রে সাময়িক ভাতা দেওয়ার চেয়ে শ্রেয় হবে তাদের কাজ দেওয়া। এ ব্যাপারে সরকারকে ভাবতে হবে। কারণ, করোনার প্রভাবে আগামীতে কর্মসংস্থানের প্যাটার্নও পাল্টে যাবে।’
তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, করোনায় কৃষিখাতে কাজ হারিয়েছেন ১ কোটি ১৪ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ পুনরায় কাজে ফিরতে পারেননি। এছাড়া শিল্পখাতে প্রায় ৯৩ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
যার ৩৭ লাখ শ্রমিকের তাদের কাজ হারানোর শিল্পে ফেরার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি সেবাখাতে ১ কোটি ৫৩ লাখ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এদের মধ্যে ৬১ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। নতুন করে আগের কাজে ফিরতে পারেননি।
এছাড়া, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এক পর্যবেক্ষণে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, চলমান করোনায় নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়বে প্রায় চার কোটি মানুষ। তৈরি পোশাক, রেস্তোরাঁ ও শিল্পকারখানা চালু রাখার সুযোগ থাকলেও নির্মাণ, পরিবহন, পোলট্রিসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত অসংখ্য মানুষের জীবিকা পড়ছে সংকটে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের হিসাবে সারা দেশে পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। কঠোর লকডাউনে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। এর আগে এক সপ্তাহের শিথিল লকডাউনেও দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে এরই মধ্যে কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন এখাতের কয়েক লাখ কর্মী।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখাতের শ্রমিকরা সবাই দিনভিত্তিক মজুরি পান। লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েছেন তারা।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)