যশোরের শার্শা-বেনাপোল সীমান্তে ১৫ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ৫১ বাংলাদেশি


২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যশোরের শার্শা ও বেনাপোল পোর্ট থানায় ৫১ জন বাংলাদেশি নাগরিকের মরদেহ উদ্ধারের খবর আছে। এর মধ্যে শার্শা সীমান্তে ৮ জন ও বেনাপোল সীমান্তে ৪২ জন। ২০২১ সালে বেনাপোল সীমান্তে এক নারী নিহত হন।
সীমান্ত হত্যা বন্ধে দফায় দফায় বাংলাদেশ ও ভারতের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গত ১৫ বছরে শুধুমাত্র যশোরের শার্শা-বেনাপোল সীমান্তেই বাহিনীটির হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন ৫১ জন। এসময় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও শতাধিক বাংলাদেশি ও ভারতীয় নাগরিক।
সীমান্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালে এই দুইটি সীমান্তে কোনো হত্যাকাণ্ডের খবর না থাকলেও এসময় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক।
শুধু সাধারণ মানুষই নন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যও রক্ষা পাননি বিএসএফের হাত থেকে। গত বছরের ২২ জানুয়ারি বেনাপোলের ধান্যখোলা সীমান্তের বিপরীতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বিজিবির সৈনিক রইস উদ্দীন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
ওইদিন ভোর আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে বিজিবি যশোর ব্যাটালিয়নের ধান্যখোলা বিওপির জেলেপাড়া পোস্ট সংলগ্ন এলাকায় ভারত থেকে আসা একদল গরু চোরাকারবারীকে সীমান্ত অতিক্রম করে আসতে দেখে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর টহল দল ‘চ্যালেঞ্জ’ করে। চোরাকারবারিরা তখন দৌড়ে ভারতের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় বিজিবি টহল দলের সদস্য সিপাহী মোহাম্মদ রইস উদ্দীন চোরাকারবারীদের পেছনে ধাওয়া করতে করতে ঘন কুয়াশার কারণে দলবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। প্রাথমিকভাবে তাকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, তিনি বিএসএফের গুলিতে আহত হয়ে ভারতের অভ্যন্তরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুরের দিকে ওই বিজিবি সদস্য মৃত্যুবরণ করেন। নিহত সিপাহী রইস উদ্দীনের মরদেহ পতাকা বৈঠকের পর ২৪ জানুয়ারি সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে ৪৯ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ।
এছাড়া সর্বশেষ ১৮ ডিসেম্বর বেনাপোলের পুটখালী সীমান্তে তিন বাংলাদেশিকে হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যার অভিযোগ রয়েছে বিএসএফের বিরুদ্ধে। প্রায় দুই মাস হতে চললেও এখনো জানা যায়নি কীভাবে তাদের মৃত্যু হলো। সে বিষয়ে এখনও পুলিশ কিছু জানাতে পারেনি। তবে নিহতদের পরিবারের দাবি, ভারতীয় বিএসএফের নির্যাতনে তাদের মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এসব হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার হয়নি।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মাথা উঁচু করে সীমান্ত হত্যার কড়া জবাব দিতে না পারলে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
সীমান্ত সূত্রে জানা যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় শার্শা-বেনাপোল সীমান্ত পথে গবাদিপশু পাচার, আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা বা ভালো কাজের খোঁজে দুই দেশের মানুষ সীমান্ত পারাপার করে থাকেন। এছাড়া সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে কৃষিকাজ কিংবা মৎস্য আহরণের জন্যও অনেককে সীমান্ত পথ অতিক্রম করতে হয়। ভুল করে কেউ ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গেলে বা অরক্ষিত সীমান্ত সামান্য অতিক্রম করলেই শুরু হয় বিএসএফের পৈশাচিক আচরণ। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধের কারণ দেখিয়ে বিএসএফের বিতর্কিত শুট অন সাইট (দেখামাত্র গুলি) নীতি সীমান্তে বহাল রয়েছে। তবে এখন গুলির পরিমাণ কমলেও নির্যাতন চালিয়ে হাত-পায়ের শিরা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। তবে তাদের এ আক্রোশের শিকার কেবল বাংলাদেশিরাই। এসব হতাহতের একটি বড় অংশ হলো গবাদিপশু ব্যবসায়ী। গত ১৫ বছরে শার্শা-বেনাপোল সীমান্তেই ৪১ বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে এখনও পরিচয় মেলেনি ৬ জনের।
নিহত গরু ব্যবসায়ীদের পরিচয় পাওয়া গেলেও দূরদূরান্ত থেকে আসা সীমান্ত পারাপারকারী অনেক নিহতের পরিচয় মেলে না। পরে স্থানীয়রা খোঁজখবর পেলেও মামলার ভয়ে তথ্য গোপন রাখেন।
বিএসএফের গুলিতে নিহত বেনাপোলের দিঘিরপাড় গ্রামের শাহাবুরের বোন রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘ভাইকে মেরে হাত-পায়ের রগ কেটে, হাত-পা বেঁধে ফেলে দেয় নদীতে। গুলি করে ভাইকে না মেরে জেলে দিলে একদিন ফিরে আসত। পরিবার এখন অসহায় হয়ে পড়েছে।’
জাহাঙ্গীরের ভাই আলমগীর জানান, তার ভাই দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ভারতে থাকেন। ভারতীয় একটি মেয়েকে বিয়ে করে ওই দেশেরই নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে বসবাস করতেন। বর্তমানে ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকায় জাহাঙ্গীর অবৈধ পথে মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ভারত থেকে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর রাতে ভারতে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। পরে ১৮ ডিসেম্বর সকালে লোকমুখে খবর পাই, জাহাঙ্গীরের মরদেহ পাঁচভুলোট সীমান্তের ইছামতী নদীর পাড়ে পড়ে আছে। পরে পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
বিএসএফের হাতে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে আব্দুল হাকিম (২৫)। তিনি নাভারণ ডিগ্রি কলেজের বিএ পাস কোর্সের ছাত্র।
আব্দুল হাকিমের বাবা নুর ইসলাম জানান, হাকিম ঢাকায় চাকরির কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। পরে খবর নিয়ে জানতে পারেন একই এলাকার মৃত মিজানুর রহমানের ছেলে হাফিজুর রহমানের (১৮) সঙ্গে অবৈধ পথে ভারতে গেছেন। ৩ দিন ভারতে থাকার পর বেনাপোলের পুটখালীর বিপরীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আংরাইল সীমান্তে এসে পৌঁছালে স্থানীয় বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের আটক করে এবং রড দিয়ে বেদম মারপিট করে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলে তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। বিএসএফের অমানুষিক নির্যাতনে হাফিজুর রহমান ঘটনাস্থলে মারা যায়। সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন আব্দুল হাকিম। তখন দু’জনই মারা গেছেন ভেবে বাংলাদেশ সীমান্তে তাদের ফেলে রেখে যায় বিএসএফ সদস্যরা। পরে সকালে স্থানীয় লোকজন হাফিজুর রহমানকে মৃত ও আব্দুল হাকিমকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে পুটখালি বিজিবি ক্যাম্পের সামনে দিয়ে একটি সাদা রংয়ের মাইক্রোবাসে করে নিয়ে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। এখনো ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না আব্দুল হাকিম।
নিহত বিজিবি সদস্য রইস উদ্দীনের শ্বশুর আবুল কালাম বলেন, রইস উদ্দিন বর্ডারে দেশ রক্ষায় জীবন দিয়ে আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়ে গেছেন। তাকে এভাবে গুলি করে হত্যা না করে যদি জেলে দিত, তাহলে হয়তো তাকে আমরা ফিরে পেতাম। এক বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যার বিচার হয়নি। শুধু আমার জামাতা নয়, বিএসএফের গুলিতে নিহত কোনো বাংলাদেশির এখন পর্যন্ত বিচার পাননি। আন্তর্জাতিক সীমান্তে এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটিরও বিচার হয়নি। তাই, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিতে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি নিহতদের স্বজনদের।
শার্শা ও বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে. এম রবিউল ইসলাম ও মো. রাসেল মিয়া জানান, ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যশোরের শার্শা ও বেনাপোল পোর্ট থানায় ৫১ জন বাংলাদেশি নাগরিকের মরদেহ উদ্ধারের খবর আছে। এর মধ্যে শার্শা সীমান্তে ৮ জন ও বেনাপোল সীমান্তে ৪২ জন। ২০২১ সালে বেনাপোল সীমান্তে এক নারী নিহত হন। এছাড়া পুলিশি ঝামেলা ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার কারণে তালিকার বাইরেও অনেক মরদেহ স্বজনরা উদ্ধার করে গোপনে দাফন করেন। সীমান্তে এত হত্যাকাণ্ড হলেও এ দুই থানায় কোনো মামলা হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থা রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এসব অমানবিক হত্যাকাণ্ড প্রায়ই ঘটছে। একটা লোক যদি অপরাধী হয়, অনুপ্রবেশকারী হয় তাকে ধরে আইনের আওতায় এনে বিচার করা উচিত। এটা উভয় দেশের সরকারের কথা বলা উচিত, তা না করে তারা গুলি করে হত্যা করছে। এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করেন তিনি। এর কড়া জবাব না দিলে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
যশোর ৪৯ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ ছিদ্দিকী জানান, বিজিবি সৈনিক রইস উদ্দীন নিহতের ঘটনায় বিচার কার্যক্রম চলমান। হত্যা বা অনুপ্রবেশ রোধে সীমান্তে নিয়মিত সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। বিজিবির পক্ষ থেকে টহল জোরদার করা হয়েছে। একমাত্র সবার সচেতনতাই ভবিষ্যতে সীমান্ত হত্যা বা যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
