সিলেট জুড়ে বন্যার পরবর্তী পরিস্থিতিতে বহুমুখী সংকট
সিলেট জুড়ে বিগত কয়েক দিনের বন্যার পরবর্তী পরিস্থিতিতে বহুমুখী সংকটে সম্মুখিন হতে হচ্ছে । পানি বন্ধি মানুষের ভোগান্তি কিছু স্বস্থি ফিরে পাচ্ছেন বাসা বাড়ি থেকে পানি নামার পর। কিন্তু স্বস্তির পেছনে এখনো রয়েগেছে দুর্ভোগ, ভােগান্তি ও কষ্টের দিন। কারণ পানি কমছে ধীরে। আর যেসব জায়গা বা ঘর ভেসে উঠছে, কেবলই দেখা যাচ্ছে ধ্বংসের চিহ্ন। নিজের ঘর-বাড়ীর ধ্বংসলীলার চিত্র দেখে সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষের মাঝে চলছে বোবাকান্না। সন্বদ্বীপের উড়ির চরে ১৯৮৫ সালে জলোচ্ছাস, অষ্ট আশির বন্যা, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার টর্নেডো, টাঙ্গাইলের মিরিখপুরে ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলা, চৌহালীর নদী ভাঙস যেখানেই হয়েছে মানুষের মধ্যে, পাড়ার মধ্যে, সমাজের মধ্যে মানুষকে ঘুরে দাঁড়ানাের চিন্তায় মগ্ন দেখা গেছে, কিন্তু এরকম কাঁদতে দেখা যায়নি।
সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যায় মানুষ অনেক ভেসে গেছে,তাঁদের ভেঙ্গেছে অনেক স্বপ্ন। সাজানো ঘরবাড়ি, হাঁড়ি-পাতিল,কাঁথা-বালিশ, কাপড়- চোপড়, গবাদি পশু, সারা বছরের খোরাকী ধান-চাল সব ভেসে গেছে। হাজার-হাজার মানুষের পরনের কাপড় ছাড়া আর কোনো কাপড় নেই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সিলেটের আকাশে উঠেছে রৌদ্রজ্জ্বল দিন। কিন্তু যে দিকে তাকানো যায় শুধু ঘর-বাড়ী ভেসে উঠছে, তাতে কেবলই ধ্বংসের চিহ্ন ভেসে উঠতে দেখা গেছে। অনেকে হারিয়েছেন প্রিয় সন্তান ও স্ত্রী কিংবা স্বামী সহ পরিবারের সদস্যদের।
এদিকে, সিলেট নগরে পানি কমলেও ভেসে উঠছে ময়লা-আবর্জনা। প্রতিদিন সকাল থেকে নগরের শাহজালাল উপশহর, মাছুদিঘির পাড় মির্জাজাঙ্গাল ও তেররতন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানি নেমে যাওয়ায স্থানীয় লোকজন বাড়ি ঘর ধোয়া মোছার কাজ শুরু করছেন। তবে দীর্ঘ দিন পানি জমে অনেকের আসবাব, কাপড় চোপড় ও বিছানার তোশক নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর থেকে পানি নেমে গেলেও বিভিন্ন বাসাবাড়ির সামনে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মহল্লার সড়কগুলো এখনো পানির নিচে। নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকার এ ব্লকের খালে পলিথিন, প্লাস্টিকের বস্তা, গাছের পাতাসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা জমে থাকতে দেখা গেছে। ময়লা-আবর্জনার কারণে খালের পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এসব আবর্জনা জমে থাকায় পানি কালো রং ধারণ করেছে। এ ছাড়া শাহজালাল উপশহরের সি.ডি.জে ব্লক ও তেররতন এলাকার মহল্লায় একই চিত্র দেখা গেছে। তবে পানি কমে আসার পর সেগুরেলা পরিষ্কার করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বন্যায় সিলেট বিভাগে ২ লাখ ৮০ হাজার স্যানিটারী ল্যাট্রিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসবের বেশীর ভাগ ল্যাট্রিন প্রান্তিক জনগোষ্টীর। ফলে বন্যাদূর্গত এলাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে এসব ল্যাট্রিন। বেশীর ভাগ এলাকা থেকে বন্যার পানি পুরোপুরি না নামার কারণে এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ব্যবহৃত হচ্ছে বেশীর ভাগ ল্যাট্রিন। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি নানা রোগব্যাধি ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলমান বন্যায় সিলেট বিভাগে ২ লাখ ৭৯ হাজার ১০৫টি স্যানিটারী ল্যাট্রিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭১৯ টি, সুনামগঞ্জ জেলায় ১ লাখ ৪ হাজার ৪৩৩ টি, মৌলভীবাজার জেলায় ১৬ হাজার ৬৩৭ টি ও হবিগঞ্জ জেলায় ১০ হাজার ২৩৬ টি ল্যাট্রিন রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পক্ষ থেকে সিলেট বিভাগে ৩১ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। এখনো মজুদ রয়েছে ২৮ লাখ ২২ হাজার ট্যাবলেট। বিভাগের ৪ টি জেলায় ১০ ও ১৫ লিটারের ১২ হাজার ৮২৭টি পানির জেরিকেন বিতরণ করা হয়েছে। এখনো মজুদ রয়েছে ২ হাজার ৫৯৮টি। সিলেট বিভাগে ১৩টি মোবাইল ওয়াটার ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট সক্রিয় রয়েছে। বর্তমানে ৭টি চলমান ও ৬টি মজুদ আছে। বিভাগে ১ হাজার ৫৪৪টি নলকূপ মেরামত করা হয়েছে। ১ হাজার ৬১৮টি নলকূপ জীবানুমুক্ত করা হয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে ইউনিসেফের সহযোগিতায় ১ হাজার ৯৪৮ টি হাইজিন কিট বিতরণ করা হয়েছে।
ক্ষয় ক্ষতির চিত্র তুলে ধরলে দেখা যায়,সিলেটে ভয়াবহ বন্যায় মৎস খামারিদের ১৪০ কোটি টাকার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। যা পুষিয়ে উঠতে সময় লাগবে ৩ বছর। সুনামগঞ্জের খামারিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রায় ৩২ হাজার ৮০২ জন খামারি ৫ হাজার ২৫৮ হেক্টর জমিতে কার্পজাতীয় মাছের চাষ করছিলেন। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মৌসুমি বৃষ্টি ও ভারতের মেঘালয় ও আসামের ঢাল থেকে নেমে আসা পানিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় তাদের আর্থিক লাভের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
গবাদী পশুর ক্ষেত্রে যে ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে তার পুষিয়ে উঠা বর্ন্যাত মানুষে লাগামি কষ্ট করতে হবে। সূত্রে জানা যায়,বন্যার পানিতে অনেক পশু নিখোজ ও মৃত্যু হয়েছে যাহা প্রকৃত পরিসংখ্যান করে বের করা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। তবে ধারনা করা যাচ্ছে যে, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় কমপক্ষে ১০ হাজার গবাদী পশুর ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মরা ও ভেসে যাওয়া পশুর সংখ্যা হবে ৫ হাজারেরও বেশী। একটি সূত্র জানায়, শুধু সিলেট জেলায় হাঁস-মুরগিসহ ৫ হাজারের বেশি গবাদিপশু মারা গেছে। আর ডুবে গেছে গবাদিপশুর ৭১০ টি খামার।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী, পানিতে ভেসে গিয়ে জেলায় এখন পর্যন্ত হাস-মুরগীসহ ৪ হাজার গবাদিপশু মারা গেছে। সিলেট জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সিলেট জেলায় ৭১০ টি খামার ডুবে গেছে। পানিতে ভেসে গেছে ১ হাজার ৯৯১ টন খড় ও ২ হাজার ৯৫৯ টন ঘাস। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত জেলায় প্রাণিসম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ১১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)