কলম থেকে কলাম
হুমায়ূন আহমেদ : সাহিত্য আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
হুমায়ূন আহমেদ : সাহিত্য আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
-তৈমুর রহমান মৃধা
“যখন মানুষের খুব প্রিয় কেউ তাকে অপছন্দ, অবহেলা কিংবা ঘৃণা করে তখন প্রথম প্রথম মানুষ খুব কষ্ট পায় এবং চায় যে সব ঠিক হয়ে যাক। কিছুদিন পর সে সেই প্রিয় ব্যক্তিকে ছাড়া থাকতে শিখে যায়। আর অনেকদিন পরে সে আগের চেয়েও অনেক বেশি খুশি থাকে যখন সে বুঝতে পারে যে কারো ভালবাসায় জীবনে অনেক কিছুই আসে যায় কিন্তু কারো অবহেলায় সত্যিই কিছু আসে যায় না”।
উক্তিটি কত সহজ সরল বাক্যে লেখা! অথচ, ভাবনার গভীরতা কত বিস্তৃত। হ্যাঁ এটাই হুমায়ূন আহমেদ। একজন লেখক, একজন কথার যাদুকর।
যিনি সহজ-সরল ভাষার মধুরতায় সৃষ্টি করেছেন এক নান্দনিক মায়াজাল। আজ এই নান্দনিক মায়াজালের রূপকারের প্রয়াণ দিবস।
হুমায়ুন আহমেদ একাধারে লেখক,সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, গীতিকার, নাট্যকার এবং অধ্যাপক (রসায়ন) হিসেবে পরিচিত।
তিনি ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি বাংলা সাহিত্যের সংলাপ প্রধান নতুন শৈলীর জনক এবং আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। ১৯৭২ সালে ‘নন্দিত নরকে’ নামে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থের নাম ছিল একটি চমক, একটি বিস্ময়। যে লেখার মধ্যে এতটা কথার যাদু ছিল, যে সাহিত্যবিশারদরা যেন এই লেখকের দিকে একটু নড়ে চড়ে বসল।
তারপর একের পর এক লেখা উপহার দিতে থাকেন যা পাঠকের হৃদয়ে ওতোপ্রোতোভাবে গেঁথে যায়। তার সৃষ্ট হিমু, মিসির আলী ও শুভ্র চরিত্রগুলির দিকে তাকলে বুঝা যায় তিনি আসলে ধূমকেতু না নক্ষত্র ছিলেন। তার হাতে গড়া চরিত্রগুলো তরুণ থেকে শুরু করে সবার ভিতরে এক গভীর স্পন্দন সৃষ্টি করেছে। জীবদ্দশায় ছিলেন তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
বাংলা সাহিত্যে সায়েন্স ফিকশনের আবির্ভাব তার হাত ধরে। হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ, গান ও উপন্যাসগুলো জনপ্রিয় হলেও টেলিভিশন নাটকগুলি ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়।
নির্মিত নাটকগুলোর ভেতর ‘কোথাও কেউ নেই’ সম্পর্কে না বললেই নয়। নব্বই দশকের বাকের ভাই চরিত্রটি আজও মানুষ মনে স্পন্দন জাগায়। এমনকি বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে দর্শকেরা হুমায়ুন আহমেদের বাড়িতে আক্রমণ করেছিলো।
গানের জগতেও এ কিংবদন্তীর বিচরণ কম ছিল না। নাটক কিংবা চলচ্চিত্রে এসব গান তিনি ব্যবহার করেছেন। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ অথবা ‘আমার ভাঙ্গা ঘরে চান্দের আলো’ গানটি জননন্দিত।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। তাই ধারণা করা হয়, সাহিত্যের প্রতি হুমায়ূন আহমেদের যে প্রবল মোহ তা পরিবার থেকে উৎসারিত।
বাবার চাকরী সূত্রে তিনি দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করেন। বগুড়া জিলা স্কুল,ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করে প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের ৫৬৪ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তার জনপ্রিয় প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে মুহসীন হলেই লেখা।
হুমায়ুন আহমেদ গাজীপুর জেলার পিজুলিয়া গ্রামে ২২ বিঘা জমির উপর তার বাগানবাড়ি নুহাশপল্লী গড়ে তোলেন। বাড়িটির নামকরণ করা হয় স্ত্রী গুলতেকিন ও প্রথম পুত্র নুহাশ হুমায়ুনের নামে। জীবনের শেষ সময়ে তিনি এই বাড়িতে থাকতে ভালোবাসতেন। তিনি বরাবর নিজেকে বিবরবাসী মানুষ দাবী করলেও বস্তুত তিনি ছিলেন মজলিশী। রসিকতা পছন্দ করলেও ভণিতা এড়িয়ে চলতেন। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও আচার-আচরণ পর্যবেক্ষক করা তার শখ ছিল। স্বল্পবাক,লাজুক প্রকৃতির মানুষ এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্তরাল জীবন-যাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তার লেখায় রাজনৈতিক প্রণোদনা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তিনি খুব ভোরে এবং মাটিতে বসে লিখতে পছন্দ করতেন। লেখার সময় তার মনোযোগ এতো তীব্র থাকতো যে সে সময় বাইরের কোনো শব্দ তার লেখার বিঘ্ন ঘটাতে পারতো না।
মায়ূন আহমেদের অন্যতম উপন্যাস হলো মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার ইত্যাদি।
হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত ‘শ্যামল ছায়া’ ও ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ চলচ্চিত্র দুটি বাংলাদেশে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারের জন্য দাখিল করা হয়েছিল।
২০১২ সালে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারি চিকিৎসার সময় তার দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। ১২ দফায় তাকে কেমোথেরাপি দেওয়ায় শারীরিক উন্নতি হলেও শেষ মুহূর্তে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমন করায় তার অবনতি ঘটতে থাকে। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ১৯ শে জুলাই ২০১২ তারিখে তিনি নিউ ইউর্কের বেলেভু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়।
লেখক:
তৈমুর রহমান মৃধা,
কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)