ভ্রমন কাহিনী
রৌদ্রজ্জ্বল পড়ন্ত বিকেলের সেই দিনটি


ফুজো চাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে নিচ তলায় আসতেই দেখি আমাদের লাগেজ বেল্টে এসে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে। এত দ্রুত সার্ভিস দেখে একটু অবাকই হলাম বৈকি। ইমিগ্রেশানের কাজ গুয়াংজু সেরে আসায় এখানে আর কোন কালক্ষেপণই হইনি। এতক্ষন এয়ারপোর্ট বা বিমানে থাকায় কমিউনিকেশনে প্রব্লেম হইনি। কিন্তু এখন একটু অন্যরকমই লাগছে, কারন চারিদিকে সাদা চামড়ার মানুষের আনাগোনা আর চাইনিজ ভাষার কিচিমিচি। রৌদ্র ঝলমল দুপুরের সূর্যটা মাথার উপর থেকে হালকা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে।
ফ্যামিলি নিয়ে বিদেশের মাটিতে এই প্রথম তাই শত ক্লান্তির মাঝেও একটু প্রশান্তি। লাগেজ আর ব্যাকপ্যাক গুলো কার্টে লোড দিয়ে অন্তুকে (আমার ৪ বছরের মেয়ে) ও কার্টের উপরে বসিয়ে কার্ট ঠেলতে ঠেলতে বাইরে বের হলাম।

ফুজো চাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।
এয়ারপোর্টের বাইরে পা দিতেই বহু ট্যাক্সি ড্রাইভার হাতের ইশারা এবং তাদের ভাষায় আমাদের ডাকছে। আমি এমন ভাব দেখালাম যে না আমি খুব ভালো চাইনিজ বুঝি, অবশেষে একজনের সাথে ভাড়া নিয়ে একটু দর কষাকষি করেই আমাদের গন্তব্য ঠিক করলাম। আমাদের সাথে নীলিমা ছিল, ওর সেবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি স্কলারশিপ হয়েছিল। যাইহোক চারটা বড় লাগেজ আর ব্যাকপ্যাকে অনেকটায় ঠাসাঠাসি করেই আমরা ট্যাক্সিতে উঠলাম। চাইনিজরা বরাবরই ইংরেজিতে দুর্বল, তাই চাইনিজ ভাষা ভালভাবে আয়ত্ত্ব করা অথবা ট্রাভেলিং গাইড ছাড়া অচেনা জায়গায় চলাফেরা সত্যিই খুব কষ্টের। এই অভিজ্ঞতাটুকু আমি বহু আগেই রপ্ত করেছিলাম, তাই আমার স্ট্যাডির প্রথম দিকে বাধ্যতামূলক চাইনিজ ভাষার কোর্স করাতে অল্পস্বল্প চাইনিজ পারতাম কিন্তু সেটা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। প্রথম বার যখন আমি একা চীনে এসেছিলাম তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন টিচার রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে যাওয়ায় তেমন ঝামেলার সম্মুখীন হইনি। কিন্তু এবার আমিই অভিজ্ঞ, বাকী সবাই আমাকে অনুসরণ করবে সেটাই স্বাভাবিক।
বিশাল বড় আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে আমাদের ট্যাক্সি হাওয়ার বেগে ছুটে চলল। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা সবুজের সমারোহ আর বিস্তীর্ণ হাইওয়ে। শুনেছি অনেক বেশি সবুজ অরন্য থাকায় ফুজিয়ান প্রদেশ নাকি চীনের সবচেয়ে ভালো এয়ার কোয়ালিটি সমৃদ্ধ এলাকা। কিছুক্ষন পর-পর ট্যাক্সি একবার ট্যানেল, একবার ফ্লাইওভার, একবার বুলেট ট্রেনের মাথার উপর দিয়ে চলছিল। আমরা সবাই অবাক দৃষ্টিতে প্রকৃতির উদরতা উপভোগ করছিলাম। হাইওয়ের গা ঘেষে চাইনিজ ঐতিহ্যের আদলে গড়া কিছু বিল্ডিং আর বুড্ডিস্ট প্রেয়ার হাউজ গুলো ছিল সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। আর হাইওয়ে গুলো মনে হচ্ছিল ফুলের বাগানের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে শত ক্লান্তির মধ্যেও অসাধারণ ভাল লাগা অনুভূতি।
কিছুক্ষন পর ড্রাইভার আমাকে কিসব জিজ্ঞাসা করছে, চাইনিজে বলায় কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমি ড্রাইভার কে বারবার বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমরা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন ক্যাম্পাস হয়ে নিউ ক্যাম্পাসে যাব। কারন নীলিমা কে মেইন ক্যাম্পাসে রেখে যেতে হবে আর আমাদের বাসা নিউ ক্যাম্পাসের পাশে। নীলিমার জন্য ডরমেটরি রেডি আছে এবং ওর আরও কিছু অফিসিয়াল ফরমালিটিও শেষ করা লাগবে। আর ডরমেটরি তে ওয়াইফ এলাও থাকলেও বেবি এলাও না সেজন্য আমাদের গন্তব্য ক্যাম্পাসের বাইরে।
এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের গন্তব্য প্রায় ৯০ কিমি এর মত। ট্রান্সেলেট করে ড্রাইভার কে বোঝানোর জন্য মোবাইল বের করলাম, কিন্তু দেখি মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। আমার জানা ছিল না যে এদেশে প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমান রিচার্জ না করলে মোবাইল কানেকশন স্বয়ংক্রিয় ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ দুই মাস দেশে থাকায় এই সমস্যা। গুয়াংজু এয়ারপোর্টে আমাদের বেশ কিছুক্ষণ ট্রানজিট ছিল। সেখানে বাসার সবার সাথে কথা বলেছিলাম এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই ব্যবহার করে। তখন সে সুযোগে কিছু টাকাও লোড দিয়েছিলাম মোবাইলে। তখন খেয়াল করা হয়নি যে মোবাইল নেটওয়ার্কে কাজ করছে কিনা। সেই টাকা যে নেটওয়ার্ক চালু হওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিল না সেটা বুঝতে পারলাম ট্যক্সির চালক কে যখন বুঝাতে যাব তখন। অন্য কোন নেটওয়ার্ক সুবিধা না পাওয়ায় মোবাইলে রিচার্জ ও করতে পারলাম না। বলে রাখা ভালো চায়নাতে মোবাইল কাজ না করা মানে আপনি পুরোটায় নিষ্ক্রিয়। কারন মোবাইল থাকলে ক্যাশ টাকার কোন দরকার হয়না। আর রাস্তাঘাট চেনা বা ট্রান্সেলেটর ব্যবহার করে অন্যদের বোঝানোর জন্যও মোবাইলের জুড়ি নেই।
কিছুদূর আসতে ড্রাইভার গাড়ি থামাল। আমাদের সবাইকে আর একটা মাইক্রো বাসে উঠতে বলল। আমরা তো রেগে আগুন, রাগ হবেই বা না কেন? সেই জার্নি শুরু হয়েছে ৪ দিন আগে। গ্রামের বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে খুলনা এসে দুই রাত ছিলাম শ্বশুর বাড়ি। এরপর ঢাকায় অফিসের গেস্ট হাউজে এক রাত। আর গেল রাতের প্রায় পুরোটাই ঢাকা টু গুয়াংজু ফ্লাইটে। তখন বিকাল ৪ টা বাজে, উনি আমাদের আরেক গাড়িতে ওঠাচ্ছে। আমি ওনার দিকে একটু রাগান্বিত হয়েই তাকালাম। উনি বুঝছে আর আমার কাছে হাত জোড় করছে। যাইহোক উঠলাম মাইক্রোবাসে, আগের থেকে এই গাড়িটা অনেক বড় সড় তাই একটু আরাম করেই বসলাম সবাই।
এবারের ড্রাইভার আগের টার চেয়ে বেশ মোটা সোটা আর দৃষ্টপুষ্ট। আগের টার চেয়ে এটা আরও বেশি প্রশ্ন করা শুরু করেছে আমাকে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না এবং উত্তর দিতে পারলাম না শুধু বারবার বললাম “ওমেন চু ফুজিয়ান নংলিং দা শুয়ে” মানে আমরা ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটিতে যাব। কিন্তু এটা ওনাকে বোঝাতে পারছি না যে আগে মেইন ক্যম্পাস পরে নিউ ক্যাম্পাসে যাব। মোবাইল নেটওয়ার্কের উপর অনেক রাগ হচ্ছিল আর খুব অসহায় লাগছিল নিজেদের।
গাড়ি প্রায় ১২০-১৩০ কিমি বেগে চলছে, পেছনে তাকিয়ে দেখি ওরা তিনজনেই ঘুমিয়ে গেছে, কাল রাত থেকে ওরা তেমন কিছুই খাইনি। এয়ারলাইনের খাবারে কিছুটা চাইনিজ গন্ধ থাকায় খেতে পারেনি। বাচ্চাটাও সামান্য একটু নুডুলস খেয়েছে। প্রথম বিমানে ওঠার কৌতূহল আর অচেনা জায়গায় আসার আনন্দে সে ও রাতে ঘুমায়নি। সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন পৌছাব। এদিকে তূর্য এবং হাবিবা আমাদের জন্য ওয়েট করছে ডরমেটরিতে। ওদের কাছে ড্রাইভারের ফোন থেকে কল করে জানিয়ে দিয়েছি যে আমরা অল্প সময়ের ভিতরে পৌছে যাচ্ছি। বাংলাদশি বলতে এখন ওরাই স্বামী-স্ত্রী একসাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে। তখন মাথায় আসলো হাসানের কাছে একটা কল দিয়ে আমাদের যাওয়ার গন্তব্য ড্রাইভারকে চাইনিজে বলে দিতে বলি। হাসান এখানে মেডিকেলে পড়ে তাই ওদের চাইনিজ জানায় লাগে। হাসান সুন্দর মত বুঝিয়ে দিল ড্রাইভারকে। আহা এখন মনে মনে শান্তি যে ঠিক জায়গাতেই যাচ্ছি আমরা।
এর পরের অভিজ্ঞতা টুকু ছিল খুবই তিক্ত। ড্রাইভারের ছিল দুইটা ফোন, সেই যে তার একটার পর একটা ফোনে কল আসতে শুরু করল আর ওনার যে লাউড আওয়াজে ফোনালাপ, পুরো গাড়ির ভিতর সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফোনটা স্টিয়ারিং এর পাশে রাখা, গাড়ীর সাউন্ড সিস্টেমের সাথে ফোনের স্পিকার এটাস্ট করা। একদিকে ওনার মিনিটে দুইবার ঢক ঢক করে ব্যারেল থেকে গ্রিন টি গেলা আর গলার উচ্চ আওয়াজ, সাথে বিপরীত প্রান্ত থেকে আসা অন্য ব্যক্তির শব্দ সেটা আবার গাড়ির স্পিকারে, দুটো মিলে সহ্য করা ছিল নিতান্তই দুরহ। ভাবলাম এইটা হয়ত শেষ কল, কিন্তু না একের পর এক চলতেই থাকল। পেছনে ওদের ঘুম গোল্লায় গেল। বাচ্চাটা ও ঘুম থেকে জেগে গেল। আমার ওয়াইফ, বাচ্চা আর নীলিমা এমন ভাব করছে যে ওদের বিদেশ আসার মজাটা আজ এই ড্রাইভারের জন্যই সব শেষ। আমাকে তারা বারবার বলছে ড্রাইভারকে একটু থামতে বল।
আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না, অবশেষে হাতের ইঙ্গিতে তাকে বোঝালাম আস্তে কথা বলেন, বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। উনি বুঝছে আমরা সবাই বিরক্ত, কারন আমরাও যে নিজেদের ভাষায় ইস-আস শুরু করেছি সেটা আর ওনার বুঝতে বাকি থাকার নয়। এরপর থেকে উনি চুপ, আর কথা বলছে না। কিন্তু ফোনে কল আসা বন্ধ নেই। যাইহোক এখন একমনে উনি গাড়ি চালাচ্ছে। এরপর ধুম করে একটা সিগারেট ধরালো। গাড়িতে এসি চালু, সব জানালা বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে সিগারেট কেমন লাগে সেটা সহজেই আচ করা যায়, তার উপর কাল থেকে পেটে তেমন কিছুই পড়েনি সবার। উনি ওনার পাশের জানালাটা খুলে যেই ১/২ টান দিছে, তখন আমি সিগারেট খেতে না করলাম। সাথে সাথে উনি ফেলে দিল। এরপর নিজের একটু খারাপই লাগল। বেচারার ফোনে কথা বলা বন্ধ করলাম আবার সিগারেট ও, না জানি আবার আমাদের কই নিয়ে যায়।
কিছুক্ষন পর আবার ফোন বেজে উঠল, উনি আর রিসিভ করে না। তাকিয়ে দেখালাম তুর্য কল করেছে। আমি ফোনটা রিসিভ করে বললাম এই তো আমরা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকছি। এরপর ডরমেটরির গেটে পৌছে নীলিমা কে নামিয়ে আমরা ফিরে এলাম। তুর্য ড্রাইভারের ভাড়াটা উই-চ্যাটে পে করে আমার মোবাইলে একটু বেশি এমাউন্ট রিচার্জ করে দিতেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ওকে হয়ে গেল। এখন একটু প্রশান্তি এবং দেখলাম আমাদের গাড়ি প্রায় বাসার কাছাকাছি পৌছে গেছে। ড্রাইভার আমাদের লাগেজ পাতি লিফটে তুলে দিয়ে হাত জোড় করে কিছুটা সরি বলার ভঙ্গিমায় বিদায় নিয়ে চলে গেল।
বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। বাসায় ঢুকতেই ক্ষিদেই পা আর চলেনা, খুজতে লাগলাম রাইচ কুকার আর সরিষার তেল কোথায় রেখে গিয়েছিলাম সেটা। নিচে গিয়ে আলু, কাচামরিচ, পেয়াজ কিনে আনলাম। অল্প সময়ের ভিতর ফ্রেশ হয়ে সরিষার তেলে আলু ভর্তা মাখিয়ে মুখে দিতেই মনে হল এমন তৃপ্তি নিয়ে হয়ত জীবনে এই প্রথম খাচ্ছি। এর কিছুক্ষণ পরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে শেষ হল আমাদের দীর্ঘ জার্নির পরিসমাপ্তি। এখনো ওই দিনের এয়ারপোর্ট টু মিনহউ (আমাদের রেসিডেন্সি এরিয়া) এর ট্যাক্সি ড্রাইভারের সেই ফোনালাপের দৃশ্য চোখে ভাসে। তবে মানুষ টা ভালোই ছিল, নিষেধ করার পরে আর একবারও রিপিট করিনি।
লেখকঃ
অজয় কান্তি মন্ডল
সাতক্ষীরার কৃতি সন্তান
পিএইচডি ফেলো
ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি ফুজিয়ান, চীন।
Email: [email protected]

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
