আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও আমাদের ভাবনা
মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল : ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এই দিনে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে। দেশ ব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। মানুষের জন্মগত অধিকার, বৈষম্যহীনতা, সমান সুযোগ ও অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনতার প্রতি সম্মানের মূলনীতিই এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য।
প্রতিবন্ধী বলতে আমরা কি বুঝি সে বিষয়টি আমাদের মধ্যে একটা ধারনা থাকাটা খুবই জরুরী।
শারীরিক ও মানসিক ত্রুটির কারণে জীবনের স্বাভাবিক গতি যাদের বাধাগ্রস্ত তাদেরকে বলা হয় প্রতিবন্ধী। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাভাবিক কাজকর্ম বা চিন্তা করতে যাদের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তারা প্রতিবন্ধী। আরও একটু পরিষ্কার করে বলতে গেলে বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ি সাধারন মানুষ যে কাজগুলো করতে পারে প্রতিবন্ধীতার কারণে সে কাজগুলো প্রাত্যাহিক জীবনে করতে না পারাটাই হল প্রতিবন্ধীতা বা (disability) । প্রতিবন্ধী হল দেহের কোন অংশ বা তন্ত্র যদি আংশিক বা সম্পূণভাবে, ক্ষনস্থায়ী বা চিরস্থায়ী ভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায় সে অবস্থাটিকেই প্রতিবন্ধী হিসেবে ধরা হয়।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের অবস্থান হিসেবে ধরা হয়, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী। সেই হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখ। এরমধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী ৩৮ লাখ, মানসিক প্রতিবন্ধী ৪২ লাখ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ৩৩ লাখ, বাক, শ্রবণ এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধী ২৫ লাখ।
যদিও বর্তমার সরকার প্রতিবন্ধীদের নতুন তালিকা করতে জরিপ কাজ শুরু করেছে। দেশে প্রথম ময়মনসিংহ জেলায় পরিচালিত জরীপ অনুযায়ি আড়াই থেকে তিন ভাগ প্রতিবন্ধী পাওয়া গেছে। সংখ্যা যাই হোক তাদেরকে সমাজের মুল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
সিএসআইডি পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৪০ দশমিক ৯৫ ভাগ নারী ও কিশোরী প্রতিবন্ধীতার শিকার হয় জন্মগত কারণে, ৩ দশমিক ৩২ ভাগ শিকার হয় ভুল ও অপচিকিৎসার কারনে। এ ছাড়া বিভিন্ন অসুখ, জ্বর, দুর্ঘটনায় ইত্যাদি কারনে ৫৫ দশমিক ৭৪ ভাগ।
স্বাধীনতার ৪১ বছর অতিক্রান্ত হলেও মোট জনসংখ্যার এক-দশমাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক তেমন কোনো কার্যকরি উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ দেশের প্রতিবন্ধীরা বরং অসহায়। আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদের সামাজিক সব অধিকার ভোগ করার কথা থাকলেও তারা বরাবরই উপেক্ষিত থাকে। আত্মীয়স্বজন সামাজিক মানমর্যাদার ভয়ে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এমনকি অনেক পরিবারেও তাদের স্বাভাবিক মর্যাদা দেয়া হয় না। শিক্ষা, চাকরি, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, বিয়ে, প্রজনন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে তারা সামাজিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতে পারে না। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সুস্থ-সবল ও শিক্ষিত একজন মানুষকে যেখানে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়, সেখানে একজন প্রতিবন্ধীর কি অবস্থা সেটি সহজেই অনুমেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য আমদের দেশের বিপুল সংখ্যক প্রতিবন্ধীর জীবিকা নির্বাহ করতে হয় ভিক্ষাবৃত্তি করে।
নানাবিধ কারনে আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা সম্ভব হয় নি। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থার দৃশ্যত তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। এরা সবচেয়ে সুবিধা বঞ্চিত, অনগ্রসর ও দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠি হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম-সুযোগ, সম-অংশগ্রহণ, সম-অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিবন্ধীদের আমানত গ্রহণ, ঋণ প্রদান ও ব্যাংক হিসাব খুলতে সহযোগিতা করাসহ সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া আছে। জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কিন্তু তার পরও প্রতিবন্ধীদের ভাগ্য পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না।
একথা স্বীকার্য যে, কোন না কোন ভাবে সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কম বেশী পরিবারে অবহেলার শিকার। অবহেলার দরুণ হতাশা, দুর্দশা, দারিদ্র্যতার অভিশাপ নিয়ে অতি কষ্টে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করে তারা। যেখানে ৮০ ভাগই জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থাতো আরো করুন। অনেক সময় অনাহারে জীবন কাটাতে হয় প্রতিবন্ধীদের। যেখানে পরিবার তিন বেলা খাবার দিতে পারে না সেখানে কিভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষার ব্যবস্থা করবে?
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অনেকটা বেকার জীবন যাপন করে বলে পরিবারেও তাদের মতামত উপেক্ষিত। অতি দরিদ্র্য পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তিকে আয়ের উৎস হিসেবে গণ্য করে ভিক্ষাবৃত্তির সাথে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করা হয়।
প্রতিবন্ধীদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের দায়িত্ব। তারা আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা আমাদের ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা। তাছাড়া ধর্মীয়ভাবেও একজন প্রতিবন্ধীর মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাই আসুন সব সংকীর্ণতা ভুলে আমরা প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু ভাবি।
লেখক :
মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল
সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)