করোনায় বড় দুর্দিনে শিক্ষিত বেকাররা
দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার। করোনা মহামারীর কারণে এ সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক তরুণ চাকরিও হারিয়েছেন।
সম্প্রতি সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার চাকরির বিজ্ঞপ্তি না থাকা ও আগের চাকরির পরীক্ষাগুলোও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়ায় শিক্ষিত বেকারদের মাথায় হাত। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
তরুণদের হতাশা প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদরা বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত ও মান শক্ত না করেই একের পর এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে।
এ কারণে বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সত্ত্বেও অনেক খাতে উচ্চ বেতন দিয়ে বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষদ খুলছে; কিন্তু সেসব বিভাগ ও অনুষদের কোনো উপযোগিতা আছে কি না দেখা হচ্ছে না।
বছর দুয়েকের ছেলে ও ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত সুস্মিতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন দুবছর হলো। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় অনলাইনে ব্যবসা চালু করেছিলেন। কিন্তু ৬ মাসও টেকেনি তা। এরপর আবার পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছেন। নিয়েছেন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি। কিন্তু চলমান পরিস্থিতি যেন সব সম্ভাবনাকে থমকে দিয়েছে।
তিনি বলেন, সংসার-ছেলে সামলিয়ে পড়াশোনা করেছি। অথচ চাকরির কোনো পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে চাকরি না পাওয়ায় পারিবারিক চাপ বাড়ছে। সংসারে অশান্তি হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি, হতাশায় ভুগছি। কিন্তু মহামারীর যে অবস্থা তাতে কবে সব স্বাভাবিক হবে এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। এদিকে বয়স থেমে থাকছে না।
করোনার করণে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি অবস্থান করছেন রাসেল রানা। ত্রিশ বছর বয়স হতে তার মাত্র দুই মাস বাকি। তিনি মনে করেন, এই সময়ের মধ্যে তার আর চাকরি পাবার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সব ধরনের পরীক্ষাই পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বাবা-মায়ের থেকে শুধু নিয়েই গিয়েছি। কিছুই করতে পারিনি।
এদিকে ৫-৭ বছর লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না পাওয়ায় প্রতিবেশী, আত্ময়ের সামনে যেতে পারি না। দেখা হলেই সকলের প্রশ্ন, কী করি। যার কোনো উত্তর এখনো আমার কাছে নেই।
চাকরিপ্রত্যাশী তানভীর হোসেন বলেন, অনেকদিন হয়ে গেলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বড় একটি নিয়োগের পরীক্ষা ক্রমাগত পিছিয়েই যাচ্ছে। গোয়োন্দা সংস্থাতে চাকরির পরীক্ষা হবে হবে করেও স্থগিত রয়েছে। শুধু এই নয়, পিছিয়েছে তিতাস গ্যাসের নিয়োগ পরীক্ষাও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়োগ পরীক্ষা না হওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের তিনটি নিয়োগ পরীক্ষা, তিতাস গ্যাস, সিলেট গ্যাস ফিল্ড, সেতু বিভাগ, পল্লী বিদ্যুৎসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব নিয়োগ পরীক্ষা কবে অনুষ্ঠিত হবে তা জানা যায়নি।
এ বিষয়ে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এ মুহূর্তে পরীক্ষা আয়োজনের সুযোগ কোথায়। মাত্র আমরা একটু গুছিয়ে নিয়েছিলাম। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এলো। সারা দেশে এখন লকডাউন চলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আমরা নিয়োগ কার্যক্রম আবারো শুরু করব।
দেশের সরকারি নিয়োগ কার্যক্রমের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। পিএসসিও করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের পরীক্ষা ও নিয়োগ বন্ধ রেখেছে।
সর্বশেষ ১২ এপ্রিল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার চাকরির আবেদন কার্যক্রমও স্থগিত করেছে সরকারি কর্ম কমশিন। এ ছাড়া ৩১ মার্চ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১০ গ্রেডের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের ফটো টেকনিশিয়ান পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, করোনাভাইরাস বেড়ে যাওয়ায় জনসমাগম হয় এমন সব নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা শারমিন নাহার বলেন, পরীক্ষা ও নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করার আগে তা গণমাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়বে। বৈশ্বিক এ মহামারীর সমস্যয় আক্রান্ত এখন সমগ্র বিশ্ব। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য জনশক্তি তৈরির পাশাপাশি তাদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সর্বশেষ গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এর বাইরে বাণিজ্য বড় হয়েছে। তবে এবার জিডিপি কম হলে কর্মসংস্থানও কমতে পারে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনে ২০৩০ সালে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখে পৌঁছাবে, যা হবে জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশ।
কিন্তু জনমিতির এই সুফল কাজে লাগাতে হলে প্রত্যেক নাগরিককে যেমন দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি তাদের উপযুক্ত কাজের সংস্থান করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, এটি এখন বৈশ্বিক সমস্যা। লক্ষ করে দেখবেন অনেক রিকশাওয়ালা এখন প্যান্ট পরছেন। এর অর্থ হলো তারা পেশা বদল করেছেন। অনেক শিক্ষিত বেকাররাও এখন এ ধরনের কাজ শুরু করেছেন। এ থেকে মুক্তি পেতে আসলে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। শুধু চাকরির মাধ্যমেই কর্মস্থান হয় না। এর জন্য বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির আহ্বান জানান তিনি।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)