যেভাবে ফযিলতপূর্ণ তারাবির নামাজের প্রচলন
যেভাবে ফযিলতপূর্ণ তারাবির নামাজের প্রচলন
প্রভাষক মাওলানা আসাদুজ্জামান ফারুকী
মুসলিম ইতিহাসের প্রায় ১৩০০ বছরে তারাবীহর নামাজের রাকআত সংখ্যা নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিলো না। এই বিতর্ক শুরু হয় গত শতাব্দীতে…
তাহাজ্জুদের নামাজের যে ফযিলত, তারাবীহরও একই ফযিলত। তবে রামাদ্বান মাসে রাতের নামাজ তথা তারাবীহর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“যে ব্যক্তি রামাদ্বানে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাতে নামাজ পড়ে, আল্লাহ তার পূর্বের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিবেন।” [সহীহ বুখারী: ৩৭]
এখন আসুন, আমরা জানবো কিভাবে তারাবীহর নামাজের প্রচলন হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ রামাদ্বানে একদিন রাতে মসজিদে যান। একা একা তারাবীহ পড়েন। তিনি কাউকে নামাজ পড়তেও বলেননি। কিন্তু সাহাবীরা তাঁর দেখাদেখি নামাজ পড়ে। পরের রাতে দেখা গেলো সাহাবীদের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। তৃতীয় রাতে মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। চতুর্থ রাতে মসজিদে তিল ধারণের জায়গা ছিলো না, কিন্তু সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে গেলেন না।
ফজরের নামাজ পড়ে তিনি উপস্থিত মুসল্লিদেরকে বললেন, “শোনো, আমি জানতাম তোমরা সারারাত ধরে এখানে আছো, কিন্তু আমি আসিনি। কিন্তু, আমি এই নামাজ তোমাদের ওপর ‘ফরজ’ হয়ে যাবার আশঙ্কা করছি (বিধায় বের হইনি)। আর তোমরা তা আদায় করতে অপারগ হয়ে পড়তে পারো।” [সহীহ বুখারী: ২০১২]
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন এবং তারাবীহর বিষয়টি অমিমাংসিত থাকে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়েও বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে প্রথম বছরে তারাবীহ নিয়ে কোনো কথা উঠেনি।
উমরের রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দ্বিতীয় বছর রামাদ্বানে তিনি মসজিদে ঢুকে দেখেন মুসল্লিরা এলোমেলোভাবে নামাজ পড়ছেন। কেউ একা একা নামাজ পড়ছেন, কেউ ছোটো ছোটো জামাতে নামাজ পড়ছেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু চাইলেন, সবাই এভাবে এলোমেলো না হয়ে যদি একজন ইমামের পেছনে নামাজ পড়তো।
তখন উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিযুক্ত করেন তারাবীহর নামাজ পড়ানোর জন্য। সবাই এক জামাতে তারাবীহর নামাজ পড়া শুরু করে। দৃশ্যটি দেখে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “কতোই না সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা!” [সহীহ বুখারী: ২০১০]
ইতিহাসের বইগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু পুরুষদের তারাবীহর নামাজের জন্য দুজন ইমাম নিযুক্ত করেন এবং নারীদের নামাজের জন্য আরেকজন ইমাম নিযুক্ত করেন। প্রথমদিকে তারাবীহর নামাজ আট রাকআত পড়া হতো, সাথে তিন রাকআত বিতর। সবমিলিয়ে এগারো রাকআত। কিন্তু, তাঁর খিলাফতের শেষদিকে তিনি আট রাকআতকে বাড়িয়ে বিশ রাকআত করেন। তিন রাকআত বিতরসহ মোট তেইশ রাকআত। [মুয়াত্তা ইমাম মালিক:২৪৪]
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কেন বিশ রাকআতের প্রচলন করেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেন আন্দালুসের বিখ্যাত মালেকী মাজহাবের স্কলার আল-বাজী রাহিমাহুল্লাহ।
তিনি বলেন, “উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এটা মানুষের জন্য সহজ করার জন্য করেন। কারণ, আট রাকআত নামাজ এতো লম্বা হতো যে, মানুষের পায়ে ব্যাথা হতো। দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ থাকতে হতো। এজন্য তিনি আট রাকআত থেকে বিশ রাকআত করেন।”
মানুষজন তখন আরেকটা জিনিসের প্রচলন করে। প্রতি চার রাকআত পর তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার নামাজ শুরু করতো। এটার ভিত্তি কী? হাদীসে আছে- আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাতের নামাজের বিবরণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বর্ণনা করেন, “তিনি চার রাকআত পড়তেন, তারপর বিশ্রাম নিতেন। অতঃপর আবার চার রাকআত পড়তেন। তুমি জিজ্ঞেস করো না তাঁর নামাজ কতোটা সুন্দর ছিলো!” [সহীহ বুখারী: ২০১৩]
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময় এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে তারাবীহর নামাজের মাঝখানে বিশ্রাম নেওয়া হতো, এটাকে আরবীতে বলে ‘তারউইহা’। এই তারউইহা থেকে তারাবীহ এসেছে যার মানে হলো অনেকগুলো ব্রেক-বিশ্রাম।
বিখ্যাত হানাফী ফকীহ ইমাম আল-সারাখসী তাঁর বিখ্যাত বই ‘আল-মাবসুত’ এ বলেন, ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ তারাবীহ শব্দের উৎপত্তির কথা বলতে গিয়ে এই যুক্তির কথা বলেন। অর্থাৎ, বিশ্রাম নেওয়া।
উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কেন বিশ রাকআতের প্রচলন করেন এটার কারণ জানা যায়নি। খিলাফতের রাজধানী মদীনায় তখন বিশ রাকআত তারাবীহ হয়, মক্কায়ও তখন বিশ রাকআত হয়। এমনকি বর্তমান সময়েও মক্কা-মদীনায় বিশ রাকআত তারাবীহ প্রচলিত।
কয়েক বছরের মধ্যে মক্কায় তখন আরেকটি কাজের প্রচলন দেখা দেয়। মক্কার লোকেরা চার রাকআতের মধ্যের ব্রেকে তারা তাওয়াফ করা শুরু করে। অনেকেই বলতে পারেন, এতো কম সময়ের মধ্যে তাওয়াফ করা কিভাবে সম্ভব? এর উত্তরে বলবো, তখন এতো জনসমাগম ছিলো না, হৈ-হুল্লোরও ছিলো না। কম সময়ের মধ্যে তাওয়াফ করা যেতো। আমি (ইয়াসির ক্বাদি) ছাত্রাবস্থায় নিজেও অনেক তাওয়াফ করেছি, যেগুলোতে সময় লেগেছে ১১ মিনিটের মতো কিংবা তারচেয়েও কম।
মক্কার লোকেরা পড়তো বিশ রাকআত তারাবীহ, পাশাপাশি করতে পারতো তাওয়াফ। এই খবরটি যখন মদীনার লোকেরা জানতে পারলো, তারা তখন চিন্তা করলো আমরা তো তাওয়াফ করতে পারবো না! তারা বিশ রাকআতের সাথে আরো ষোলো রাকআত তারাবীহ পড়া শুরু করলো। সবমিলিয়ে ছত্রিশ রাকআত তারাবীহ (তিন রাকআত বিতর মিলিয়ে উনচল্লিশ রাকআত)। এটা ছিলো তাবেঈ, তাবে-তাবেঈদের যুগে।
ইমাম জাফরানী ইমাম আশ-শাফে’ঈ রাহিমাহুল্লাহকে তারাবীহর রাকআত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ইমাম শাফে’ঈ বলেন,
“আমি মদীনার লোকদেরকে উনচল্লিশ (৩৬+৩) রাকআত পড়তে দেখেছি এবং মক্কার লোকদেরকে তেইশ (২০+৩) রাকআত। তুমি এই দুটো মতের যেকোনো একটা ফলো করতে পারো, কোনো অসুবিধা নেই।”
দেখুন, ইমাম আশ-শাফে’ঈ বলছেন, মক্কার লোকেরা তেইশ রাকআত পড়ে, মদীনার লোকেরা উনচল্লিশ রাকআত, তুমি যেকোনো একটা ‘ফলো’ করলেই হবে। এই পজিশনটি ইসলামের ইতিহাসে ছিলো সবচেয়ে স্ট্যান্ডার্ড পজিশন। অর্থাৎ, একটা পড়লেই হলো।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আযাদকৃত দাস না’ফে রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “মদীনার মানুষকে আমি ৩৯ রাকআত তারাবীহর নামাজ পড়তে দেখেছি, যারমধ্যে ৩ রাকআত বিতর নামাজ অন্তর্ভুক্ত।”
অনেকেই অবাক হতে পারেন, এই ৩৯ রাকআত কোথা থেকে আসলো? এটা সাহাবী/তাবেঈদের সময় থেকেই চলে আসছে। মদীনার গভর্নর ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহকে তারাবীহর নামাজের রাকআত সংখ্যা কমানোর জন্য বললে ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ প্রতিউত্তরে বলেন: “আমি মানুষজনকে এটার উপর আমল করতে দেখেছি এবং এটি পূর্ববর্তীদের আমল।”
ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ, যিনি জন্মগ্রহণ করেন ৯৩ হিজরিতে, তিনি বলছেন ‘পূর্ববর্তীদের আমল’; যিনি নিজেও ছিলেন একজন পূর্ববর্তী। তাহলে তাঁর পূর্ববর্তী কারা? সাহাবী, তাবে’ঈ।
পূর্ববর্তী আলেমগণ আলোচনা করতেন তারাবীহর নামাজ কতো রাকআত পড়া ‘উত্তম’ এটা নিয়ে। বেশিরভাগ বলতেন বিশের পক্ষে (২০+৩)। কারণ, এটার ওপর সাহাবীদের ইজমা ছিলো। উমর ইবনুল খাত্তাবের আমল থেকে এটা প্রচলিত।
যেকোনো নফল নামাজের ক্ষেত্রে সংখ্যাগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটা এমন না যে ২০ রাকআতই পড়তে হবে, ৩৯ রাকআতই পড়তে হবে। নফল নামাজের ক্ষেত্রে যতো বেশি পারবেন পড়বেন। কোনো কারণে পড়তে অপারগ হলে যতোটুকু পারেন পড়ুন। কিন্তু, আমরা এসব বাদ দিয়ে নফল নামাজের রাকআত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করি!
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! তারাবীহ আট না বিশ রাকআত এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন না। আমার জানামতে ইসলামের তেরশো বছরের ইতিহাসে এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিলো না। এটা নিয়ে প্রথম ঝামেলা শুরু হয় গত শতাব্দীতে! এটা একটি আধুনিক বিতর্ক।
গত শতাব্দীর একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস, খুব দক্ষ আলেম রাহিমাহুল্লাহ প্রথমবারের মতো দাবী করলেন- বিশ রাকআত তারাবীহ হলো বিদআত! এর আগে আমার জানামতে কেউ এমন দাবী করেননি।
আমার শিক্ষক শায়খ ইবনে উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “যে বলে আট রাকআতের বেশি তারাবীহ পড়া বিদআত, সে নিজেই আসলে বিদআত বলছে। কারণ, এর আগে কোনো আলেম এটাকে বিদআত বলেননি।”
তারাবীহর নামাজ কোনো সংখ্যাগত বিষয় বা কোয়ান্টিটি না, এটা হলো কোয়ালিটি। এটা ফরজও না যে কমালে বাড়ালে ক্ষতি হবে। এটা নফল নামাজ। আপনি আপনার ইচ্ছেমতো আট রাকআত পড়ুন, বিশ রাকআত পড়ুন কিংবা ছত্রিশ রাকআত।
আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারাবছর রাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়তেন। তিনি রাতে পড়তেন আট রাকআত। কিন্তু, তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিয়ে যাননি- আট রাকআত পড়তেই হবে। এমনকি একবার একজন সাহাবী এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি রাতের নামাজ কিভাবে আদায় করবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “দুই রাকআত দুই রাকআত করে আদায় করবে। আর যদি আশঙ্কা করো ফজরের সময় হয়ে যাচ্ছে, তখন বিতর পড়া শুরু করবে।” [সহীহ বুখারী: ৪৭২]
এই মতটিই ছিলো দীর্ঘ তেরশো বছর ধরে মুসলিম উম্মাহর মত। এই তেরশো বছরে কেউ কখনো বলেনি- বিশ রাকআত তারাবীহ পড়া বিদআত। সুতরাং, আপনাকে কেউ এসে যদি বলে, “তুমি বিশ রাকআত পড়ছো কেন? তুমি কি জানো না বিশ রাকআত পড়া বিদআত?” তাহলে আপনি জবাবে বলবেন, “জাজাকাল্লাহু খাইরান। আপনি আট রাকআত পড়ুন, আমি বিশ রাকআত পড়ি।”
[লেখাটি শায়খ ইয়াসির ক্বাদির লেকচার থেকে অনূদিত।]
লেখক:
মাওলানা আসাদুজ্জামান ফারুকী,
খতিব, কলারোয়া থানা জামে মসজিদ, সাতক্ষীরা।
প্রভাষক, সামটা সিদ্দিকিয়া ডিগ্রি মাদ্রাসা, শার্শা, যশোর।
বিশিষ্ট সাংবাদিক, চিকিৎসক, ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও গবেষক।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)