গবেষণা: অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ দিতে পারে আজীবন সুরক্ষা
গবেষণার ভিত্তিতে সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ টিকা কভিড-১৯ থেকে আজীবন সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি ছাপা হয়েছে বিজ্ঞানবিষয়ক নেচার সাময়িকীতে।
গবেষকরা বলছেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা তৈরি হয়েছে অ্যাডিনো ভাইরাস ব্যবহার করে। ফলে অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে বেশি কার্যকর হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার পাশাপাশি মানানসই যুক্তিও ব্যাখ্যা করেছেন গবেষকরা।
তাঁদের দাবি, অ্যাডিনো ভাইরাস মানবদেহের গঠনের সঙ্গে অত্যন্ত পরিচিত। অ্যাডিনো ভাইরাসের খোলের মধ্যে করোনার স্পাইক প্রোটিন ভরে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি করা হয়েছে। টিকা নিলে অ্যাডিনো ভাইরাস মানবদেহের ফাইব্রোব্লাস্টিক রেটিকিউলাস সেলে ঢুকে পড়ে। এ ধরনের কোষ যথেষ্ট দীর্ঘায়ু। তা শরীরে ঢোকার পর ‘আইএল ৩৩ সাইটোকাইনের’ নিঃসরণ ঘটে, যা মানবদেহে থাকা টি-সেলের প্রশিক্ষণের পরিবেশ তৈরি করে দেয়। টি-সেলকে শেখানো হয়, যে চেহারা নিয়েই করোনা শরীরে প্রবেশ করুক, তাকে চিনে নিয়ে দুর্বল করে দেবে টি-সেল। কোষের ভেতরে এই প্রশিক্ষণ চলতেই থাকে। ফলে অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুটি ডোজই একজন মানুষকে করোনা থেকে আজীবন সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
গবেষণালব্ধ ফলকে উদ্ধৃত করে ভারতের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার বলছেন, এ টিকা নেওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। উদ্দীপ্ত হয় মেমোরি টি-সেল। সময়ের সঙ্গে অ্যান্টিবডির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু রয়ে যায় টি-সেলের সুরক্ষা। অ্যাস্ট্রাজেনেকা এ ক্ষেত্রে মডার্না বা ফাইজারের মতো আরএনএ টিকাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।
সূত্র : দ্য সান।
এদিকে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে টিকার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। টিকা কীভাবে তৈরি হয়?, কোভিডের টিকা কীভাবে তুলনা করা হয়?, কী কী কোভিড ভ্যাকসিন রয়েছে?, করোনাভাইরাসের কতগুলো টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে? ইত্যাদি। সেগুলোও তুলে ধরা হলো।
টিকা কীভাবে তৈরি হয়?
কোন একটি রোগের জীবাণু যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্যারাসাইট কিংবা ফাঙ্গাস যখন শরীরে প্রবেশ করে তখন এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শরীরের অ্যান্টিজেন উপাদানটি অ্যান্টিবডির উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়।
সচরাচর, দৈনন্দিন জীবনাচরণের সময় কোনো দেহে জীবাণু প্রবেশ করার আগে অ্যান্টিজেনের একটি নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল অংশ দেহে প্রবেশ করিয়ে দেয় টিকা। তখন দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ওই আসল জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং প্রতিহত করে।
নতুন এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই আসলে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরি করা হয়েছে।
কোভিডের টিকা কীভাবে তুলনা করা হয়?
ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্না দুটি টিকাই মেসেঞ্জার আরএনএ ভ্যাকসিন যা ভাইরাসের জেনেটিক কোড ব্যবহার করে।
দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় অ্যান্টিজেন ব্যবহারের পরিবর্তে এই টিকাগুলো দেহের কোষকে শেখায় যে কিভাবে একটি “স্পাইক প্রোটিন” তৈরি করতে হবে। এই স্পাইক প্রোটিনটি কোভিড-১৯ ভাইরাসের উপরিভাগে থাকে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যে অ্যান্টিবডি দরকার হয় সেটি তৈরি করতে সাহায্য করে এই প্রোটিন।
অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন আবার আলাদা- শিম্পাঞ্জিকে আক্রান্ত করতো যে সাধারণ সর্দি লাগার ভাইরাস বিজ্ঞানীরা সেটিকে কিছুটা রূপান্তরিত করে তার সাথে কোভিড-১৯ ভাইরাসের জেনেটিক কোডের কিছু অংশ জুড়ে দিয়েছেন।
এই তিনটি টিকাই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের জন্য অনুমোদিত। মেক্সিকো, চিলি এবং কোস্টারিকায় ফাইজার টিকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ব্রাজিলে অক্সফোর্ড ও সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের অনুমোদন রয়েছে।
আরো কী কী কোভিড ভ্যাকসিন রয়েছে?
বেইজিং ভিত্তিক সিনোভ্যাক এর তৈরি করা করোনাভ্যাক নামের টিকা এরইমধ্যে চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিন্সে দেয়া শুরু হয়েছে। এই টিকাটি প্রচলিত পদ্ধতি অর্থাৎ ভাইরাসের মৃত বা নিষ্ক্রিয় অংশ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।
তবে এই ভ্যাকসিনটির কার্যক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত শেষ পর্যায়ের ট্রায়ালের তথ্য আসার পর এই প্রশ্ন ওঠে। আর ব্রাজিলের গবেষকরা এরই মধ্যে বলেছে যে এই টিকাটি মাত্র ৫০.৪% কার্যকর।
ভারতে কোভিশিল্ড নামে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মিলে এই ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া ভারত বায়োটেক নামে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান কোভ্যাক্সিন নামে একটি টিকা উৎপাদন করছে।
রাশিয়া তাদের নিজেদের তৈরি ভ্যাকসিন ভেক্টর ভ্যাকসিন স্পুটনিক ভি ব্যবহার করছে। যা ভাইরাসের একটি ভার্সন বা রূপ থেকেই বানানো হয়েছে। এই টিকাটি আর্জেন্টিনায়ও ব্যবহার করা হচ্ছে। এরইমধ্যে টিকাটির ৩ লাখ ডোজ অর্ডার করেছে দেশটি।
ফাইজার, ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটের অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন এন্ড জনসনের প্রায় ২৭০ মিলিয়ন ডোজ টিকা কেনার অর্ডার দিয়েছে আফ্রিকান ইউনিয়ন। তবে জনসন এন্ড জনসন কোম্পানির টিকাটি এখনো ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে।
তবে গ্লোবাল কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় আরো ৬০০ মিলিয়ন ডোজ টিকা পাওয়ার কথা রয়েছে আফ্রিকান ইউনিয়নের। কোভ্যাক্স কর্মসূচিটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং গাভি নামে একটি ভ্যাকসিন অ্যালায়্যান্সের যৌথ তত্ত্বাবধানে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য টিকা নিশ্চিত করতে পরিচালিত হয়।
করোনাভাইরাসের কতগুলো টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে?
বৈশ্বিকভাবে ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে নেমেছে ২শ টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, তাদের তালিকায় প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে ১৫৪টি ভ্যাকসিন।
এছাড়া ফেস-ওয়ানে ছোট আকারে নিরাপত্তা নিয়ে ট্রায়ালে রয়েছে ২১টি ভ্যাকসিন। ফেস টু-তে নিরাপত্তা ট্রায়ালে রয়েছে ১২টি এবং ফেস-থ্রি-তে বিস্তারিত পরীক্ষা এবং কার্যকারিতার ট্রায়ালে রয়েছে আরো ১১টি ভ্যাকসিন।
আরো যেসব টিকার ট্রায়াল এখনো চলছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাশিয়ার স্পুটনিক ভি। বলা হচ্ছে এটি অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের মতোই কাজ করবে এবং এটি ৯২% সুরক্ষা দেবে বলে এখনো পর্যন্ত জানানো হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার মানুষের উপর পরীক্ষা করা হচ্ছে জ্যানসেন’স নামের একটি টিকা। পুরো বিশ্বে এই টিকার ট্রায়ালে অংশ নিয়েছে ৩০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী।
চীনের সিনোফার্ম ও উহান ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস চূড়ান্ত ট্রায়ালে রয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার গামেলিয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউটেরও একটি ভ্যাকসিন ট্রায়ালে রয়েছে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)