প্রণোদনা প্যাকেজ: ‘বড়’রা ঋণে ভাসলেও ‘ছোট’রা তলানিতে


করোনাভাইরাস মহামারীর ক্ষতি সামলে উঠতে লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বড় বড় উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে প্রায় শেষ করে ফেললেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ নগণ্যই রয়ে গেছে।
২৪ অগাস্ট পর্যন্ত ৩৩ হাজার কোটি টাকার বড় ঋণের মধ্যে ২০ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ইতোমধ্যে বিতরণ করে ফেলেছে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ বিতরণ হয়েছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।
অন্যদিকে ২০ হাজার কোটি টাকার ছোট ঋণের মধ্যে বিতরণ হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৭৩ কোটি টাকা বা সাত ভাগের এক ভাগ।
শতাংশ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বড় ঋণ বিতরণ ৬৩ শতাংশ হলেও ছোট ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ।
ছোট অঙ্কের ঋণ বিতরণ না হওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোর আগ্রহহীনতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতির গবেষক ও ব্যবসায়ী নেতারা।
ঘোষণা দিয়ে ছোট ঋণের ঝুঁকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক নেওয়ার পরও এ খাতের ঋণ বিতরণ না বাড়ায় হতাশ তারা।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ছোট ঋণ পুরোটা বিতরণ হয়ে যাবে।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় গত ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন।
এরমধ্যে সবচেয়ে বড় প্যাকেজ ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকার, শিল্প ও সেবা খাতের জন্য। ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) জন্য। পরে শিল্প ও সেবাখাতের প্যাকেজের অঙ্ক ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়।
এই দুই প্যাকেজের অর্থের অর্ধেক অর্থাৎ ১৫ হাজার এবং ১০ হাজার মোট ২৫ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে।
দুই প্যাকেজেরই ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিশোধ করবে ঋণ গ্রহিতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
ছোট ঋণ বিতরণের হতাশাজনক চিত্র নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বড় ব্যবসায়ীদের এক ব্যবসার ক্ষতি অন্য ব্যবসা দিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে, যেটা ছোট ব্যবসায়ীদের থাকে না।
“এই চার-পাঁচ মাসে অতি ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা পুঁজি ভেঙে সংসারের খরচ মিটিয়েছেন। সরকারের সহায়তা ছাড়া এরা আর দাঁড়াতে পারবেন না। অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন না।”
“তাই এদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং দ্রুত সেই কাজটি করতে হবে। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে, আমরা বড় বড় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের দিকেই বেশি মনোযোগ দেখছি। ছোটদের অবহেলা করছি,” বলেন তিনি।
অর্থনীতি জাগাতে হলে ছোট ব্যবসাও ‘বাঁচাতে হবে’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, “১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে দেশের ৬০ লাখ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যারা নানা ধরনের ব্যবসা করে পেট চালাতেন, তারা এখন পুঁজি ভেঙে চলছেন। অনেকে নিঃস্ব হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সত্যিই খুব খারাপ অবস্থা।”
আর মুদি দোকান থেকে শুরু করে সারা দেশের ছোটখাটো বিভিন্ন পণ্যের দোকান এবং বিপণি বিতানের ৫৭ লাখ ব্যবসায়ী ‘মুখ থুবড়ে পড়েছেন’ বলে মন্তব্য করেন হেলাল।
“সবচেয়ে বড় বিপদের মধ্যে আছেন এ সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এক কোটির বেশি কর্মচারী ও তাদের পরিবার। দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বার বার অনুরোধ করার পরও এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কিছুই করা হয়নি।”
তিনি বলেন, মহামারীর কারণে পহেলা বৈশাখ, রোজার ঈদ এবং সর্বশেষ কোরবানির ঈদেও ব্যবসা হয়নি। কোরবানির ঈদে দোকানপাট খোলা থাকলেও গত বছরের বেচাকেনার ১০ শতাংশও এবার হয়নি।
মহামারীর ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা এই শ্রেণির হাতে আসেনি জানিয়ে হেলাল বলেন, “ব্যাংকগুলো ব্যস্ত বড় বড় ব্যসায়ী শিল্পপতিদের নিয়ে, যারা লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আটকে রেখেছে, ফেরত দিচ্ছে না, খেলাপি হয়ে আছে।”
দেশের অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফেরাতে চাইলে ছোট ব্যবসায়ীদের প্রতিও নজর দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।
“অতি ক্ষুদ্র ব্যবসা ঘুরে না দাঁড়ালে, ছোট-মাঝারি ব্যবসা সচল না হলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে না। তাই সবার আগে এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”
তার সঙ্গে একমত পোষণ করে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেষ ফজলে ফাহিম বলেন, “তাই আমি মনে করি, শুধু বড় বড় উদ্যোক্তা নয়; সবার পাশেই ব্যাংকগুলোর দাঁড়ানো উচিৎ।”
তিনি বলেন, নানা অজুহাতে ব্যাংকগুলো ছোট ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখায় না। অথচ এই ঋণ খেলাপি হওয়ার নজির খুবই কম। তারপরও ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কেন ঋণ দিতে চায় না বুঝতে পারি না।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, চাহিদা বিবেচনায় ব্যাংকগুলো প্রথমে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতার অর্থ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে বড় শিল্পে ঋণ দেওয়া হয়েছে।
“এখন সিএমএসএমইসহ সব ধরনের ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। গ্রাহকপ্রতি ঋণের পরিমাণ কম হওয়ায় এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগছে। আশা করছি, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ছোট ঋণ বিতরণেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হবে।”
মির্জ্জা আজিজ বলেন, “যেহেতু বড় ঋণ বিতরণ একটা পর্যায়ে চলে এসেছে, এখন ছোটদের দিকেই সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।”
ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে আগ্রহী করতে খেলাপি করার সময় বাড়ানো, প্রভিশন কমানোসহ নানা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এসবের পাশাপাশি ২ হাজার কোটি টাকার ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম করা হয়েছে। এ স্কিমের আওতায় সিএমএসএমই খাতের প্রণোদনার ঋণ কোনো কারণে খেলাপি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা দিয়ে দেবে।
এর ফলে ছোট ঋণ বিতরণে গতি আরও বাড়বে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “সত্যি কথা বলতে কি, ব্যাংকগুলো আসলে এতদিন বড় ঋণ নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিল। সেগুলো বিতরণ প্রায় শেষের পথে। এখন ব্যাংকগুলো ছোট ঋণ বিতরণে আগ্রহী হবে।”
সিএমএসএমই খাত ঋণ বিতরণের সময়সীমা আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এসব তহবিলের মেয়াদ হবে তিন বছর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ছোট-বড় শিল্প খাতের ৫৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে গত ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ১১ হাজার ৬৭ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মাঝে ২৪ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে। এরমধ্যে শিল্প ও সেবা খাতের ৩৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণ পেয়েছে ১ হাজার ৫১৭টি প্রতিষ্ঠান।
কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প বা সিএমএসএমই খাতের ৯ হাজার ৫৫০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঋণ বিতরণ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, বড় প্যাকেজ দুটির বাইরে নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এনজিওর মাধ্যমে বিতরণের লক্ষ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল করা হয়। গত ২৪ আগস্ট পর্যন্ত এ তহবিল থেকে ৩৬টি এনজিও ৯ হাজার ৮৮২ জনের মাঝে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে।
পোলট্রি, মৎস্য, ডেইরি, প্রাণিসম্পদ, মৌসুমভিত্তিক ফুল ও ফল চাষের জন্য গঠিত ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ১৭ হাজার ৮০১ জনকে ৫০০ কোটি টাকার মতো দেওয়া হয়েছে।
পোশাক শিল্প
গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী রপ্তানিমুখী শিল্পের বিশেষ করে পোশাক শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এই তহবিল থেকে মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ নিয়ে এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেন পোশাক কারখানার মালিকরা।
পরে পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য আরও তিন মাসের (জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর) প্রণোদনা চাইলে জুলাইয়ের জন্য আরও তিন হাজার কোটি দেয় সরকার।
বড় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার যে তহবিল গঠন করা হয়েছিল তার পরিমাণ আরও তিন হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা করে ওই তহবিল থেকে জুলাই মাসের বেতন দেওয়ার জন্য ঋণ দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে মালিকদের সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ দিতে হয়েছে।
এরইমধ্যে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ আরও তিন মাসের (অগাস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) বেতন দিতে সরকারের কাছে অর্থ চেয়েছে।
গত ২০ অগাস্ট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে লেখা এক চিঠিতে এই অর্থ চেয়েছে দুই সংগঠন।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র আবেদনের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার বলেন, “পোশাক শিল্প মালিকদের চিঠি আমার দপ্তরে এসেছে। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
“আগের বার দাবি করার আগেই প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন। এটারও সম্পূর্ণ এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি নির্দেশনা দিলে আমরা সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
