স্বাধীনতার ৫০বছরেরও শহীদ স্বীকৃতি পায়নি দেবহাটার কুলিয়ার শহিদ মেম্বর
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও শহীদ স্বীকৃতি পায়নি কুলিয়ার শহিদ মেম্বর। এমনকি তার হত্যাকান্ডের কোনো বিচারও হয়নি আজও। এনিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। কেন কী কারনে কিভাবে কারা তাকে হত্যা করলো এসব বিষয়ে কথা বলেন শহিদ মেম্বরের বড় মেয়ে মাছুরা খাতুন।
তিনি বলেন, আমার বয়স তখন আট বছর। সে দিন ছিল বাংলা ১৭ আষাঢ় ১৩৭৬, ২ জুলাই ১৯৭১ শুক্রবার। আমার ছোট চাচা আমির হোসেনকে সাথে নিয়ে আব্বা মাঠে যান ধানের বীজতলা তৈরি করতে। সাথে ছিল আমার বড়ভাই আনসার আলী সরদার। মাঠে কাজ করার সময় আমার ছোটচাচা আমির হোসেনকে বলে ‘বাবু’ আমি বাড়ি যাবো। তখন ছোটচাচা বলে ভাই এখন বাড়ি যাবার দরকার নেই শুনলাম খান সেনারা এসেছে। অব্বা ছোট চাচার কথা উপেক্ষা করে বাড়িতে চলে আসেন। বাড়ি এসে গোসল করে আমার বড় ভাবিকে (ফিরোজা বেগম) বলেন, ভাত দাও। ভাত খেয়ে বালিয়াডাঙ্গা সরদারপাড়া জামে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে যান। তখন আমার মা’কে (আনোয়ারা বেগম) বলে যায় গরুর জন্য বিচলি কেটে রেখো। এমন সময় আমার মা আমার বড়ভাইকে বলে ‘খোকা’ খান সেনারা দেখলাম রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। তুই মসজিদে গিয়ে তোর আব্বাকে খবরটা দিয়ে আয়। আমার বড় ভাই আনসার সরদার মসজিদে গিয়ে বাইরে থেকে দেখে মসজিদ খান সেনারা ঘিরে রেখেছে। খান সেনাদের দেখে ভয়ে আমার বড়ভাই ইছাহক সরদারদের বাড়ির ধানের গোলার তলায় পালিয়ে থাকে। মসজিদে তখন জুমার সুন্নত নামাজ শেষ হয়েছে অথবা ফরজ নামাজ শেষ হয়নি। তখন খান সেনারা মসজিদের সকল মুসলি¬কে বের হয়ে আসতে বলে। তখন আমার আব্বা মসজিদের ভিতরে ছিল। শেষে যখন তাকেও বের হতে বলে তখন আব্বা দেখেন বাইরে তৎকালিন কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল গফফার সরদার দাঁড়ানো। আব্বা তখন কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের আমাদের ওয়ার্ডের মেম্বর (ইউপি সদস্য)। সে কারণে গফফার সরদারকে দেখে সরল বিশ্বাসে মসজিদ থেকে আব্বা বের হয়ে আসে। এরপর সবাইকে একসাথে ধরে নিয়ে রাস্তার ওপরে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখে খান সেনারা। ওখান থেকে কয়েকজন সেনা গফুর সরদার (তখন লন্ডির দোকানদার) ও ফুট্টু চাচাকে (ফরিদ আহমেদ) সাথে নিয়ে আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার জন্য আসে। তখন মায়ের একটি বাক্সে কাপড়-চোপড় ছিল। সেটা বাইরে বের করে দেয়। তখন আমরা ঘর থেকে বের হয়ে আব্দুল চাচার ঘরের পিছনে গাছের মধ্যে পালাই। তখন ফুট্টু চাচা বলে এ বাড়ি শহিদ মেম্বরের না। অন্য ঘর দেখিয়ে দিলে খান সেনারা তখন চলে যায়। তখন খান সেনাদের পিছু পিছু যায় আমার দাদি (রহিমন বিবি)। সেখানে গিয়ে খান সেনাদের পা জড়িয়ে ধরে আমার দাদি আকুতি মিনতি করতে থাকে। তাদেরকে অনেক অনুরোধ করে বলে আমার ছেলেকে তোমরা ছেড়ে দাও, ওকে ধরে রেখেছো কেন? ওর অনেকগুলি ‘বাইল বাচ্চা’ (সন্তান)। তখন তারা এমন জোরে আমার দাদিকে বুটের লাথি মারে যে আমার দাদি ছটকে একটি কাটা গাছের মধ্যে পড়ে যায়। এতে আমার দাদি পা কাটা গাছের গোড়ায় ফটে গিয়ে কেটে রক্তাত্ত জখম হয়। দাদি কাঁদতে কাঁদতে রক্তাত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসে। এর কিছু সময় পরে খান সেনারা আমার আব্বাকে সেখান থেকে নিয়ে সাতক্ষীরা অভিমুখে রওয়ানা হয়। পাটনীপাড়ার ওখানে আগে থেকে খানদের গাড়ি দাড় করানো ছিল। টুকু ভাই আর আব্বা ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দিয়ে গাড়ির ওখানে নিয়ে যায় খান সেনারা। গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবার কিছু সময় পর একটা বাইসাইকেলে ১০হাজার টাকা নিয়ে সাতক্ষীরার দিকে যেতে থাকে আমার ছোট চাচা আমির হোসেন বাবু। ছোট চাচা পুস্পকাটি পর্যন্ত পৌছালে দেখা হয় চাল ব্যবসায়ি রহমাত পাটনীর সাথে। রহমত পাটনী তখন সাতক্ষীরা থেকে চাল বিক্রি করে সাইকেলে ফিরে আসছিল। তখন আমার ছোট চাচাকে যেতে দেখে সাইকেল থামিয়ে বলে, বাবু কোথায় যাচ্ছো? তোমার আর যাওয়া লাগবে না তুমি বাড়ি ফিরে চলো তারপর বলছি। তার কথামত বাড়ি ফিরে আসতে থাকেন দু’জন। বাড়ির কাছাকাছি আসলে বলে তোমার ভাই আর নেই। তাকে আলীপুর দীঘিরপাড় এলাকায় হত্যা করা হয়েছে তুমি বাড়ি যাও। এই শুনে রাস্তার ওপরে পড়ে পড়ে যান আমার ছোটচাচা। সাইকেল থেকে পড়ে অচেতন হয়ে যান তিনি। পরে তাকে বাড়ি আনা হয়। তারপর বাড়ির সকলে জানতে পারে আব্বাকে খান সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে।
এখবর শোনার পরে আমরা প্রত্যক্ষদর্শী লোকজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম আমার আব্বাকে প্রথমে খান সেনারা হাতে গুলি করে। তখন আমার আব্বা মারা যায়নি। এটা লক্ষ্য করেছিল খান সেনাদের দালাল গফফার চেয়ারম্যানের ছেলে আব্দুল জলিল। তখন জলিল বলে ‘তোমাদের গুলিতে তো শহিদ সরদার মরেনি’। আবার গুলি করো’। খানেরা আর গুলি না করে চলে যেতে চাইছিল। তখন জলিল এক খান সেনার কাছ থেকে নিজে রাইফেল কেড়ে নিয়ে পেটের পাশে গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। সেইগুলি পেটের অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাকে। এরপর সেখানে আব্বার নিথর লাশ ফেলে রেখে তারা চলে যায়।
আমার আব্বার সাথে আটক হওয়া মনিরুজ্জামান (টুকু) ভাইকেও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আশপাশের লোকজন উদ্ধার করে সাতক্ষীরার নিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য। ওইদিন রাতে এশার নামাজের পর রশিদ চাচা (রশিদ সরদার) মেজ চাচা (আবুল হোসেন) ও ছোট চাচা (আমির হোসেন বাবু) বহেরার মাঠ দিয়ে আলিপুর দিঘির পাড়ে যায়। আর একজনকে নিয়ে সেখান থেকে একটি খাটিয়ায় করে আব্বার লাশ আবার সেই গোজওয়ালা ধানের মাঠ পেরিয়ে নিয়ে আসে। তখন সম্ভবত রাত দুইটা-আড়াইটা হবে।
পরদিন শনিবার প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কবর খুড়তে পারছে না এত পানি, কবরে পানি উঠে যাচ্ছে। ওপরে পলিথিন টানিয়ে কোনোরকমে কবর খোড়া হয়েছিল। আব্বার মরদেহ তখন আমাদের মাটির ঘরের বারান্দায়। তার লাশ অর্ধেক বাইরে, অর্ধেক ঘরের মধ্যে। আব্বার শরীরের রক্ত বর্ষায় পানি দিয়ে মৃত শরীর ধুয়ে পানি লাল হয়ে উঠোন ভরে গিয়েছিল। আমরা সেই রক্ত পানি কেটে কেটে পাশের খালে ফেলে আসি। পরে আব্বাকে গোসল করিয়ে জানাযা শেষে দাফন করা হল। এর পরদিন খবর এলো মনিরুজ্জামান (টুকু) ভাইও মারা গেছে। আব্বার ওই খাটিয়া নিয়ে টুকু ভাইকে আনা হয়। পরে তাকেও আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আমার দাদিকে যে খান সেনারা লাথি মেরে ফেলে দেয় তার পায়ের পাতায় এক গাছের শুলো ফুটে গিয়েছিল সেখানে প্রচন্ড ক্ষত সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষত থেকে আমার দাদির পায়ে ঘা হয়। সেই ঘা’য়ের ক্ষত এত প্রকট আকার ধারন করে যে দুই বছর মারাতœক অসুস্থ হয়ে রোগ ভোগের পর আমার দাদিও মারা যায়।
আমার আব্বা যখন মারা যায় তখন আমার ছোট বোন লতিফোন নেছা তিন মাস পেটে। মেঝ বোন মর্জিনার বয়স দুই বছর। আমার আট বছর। আমার ছোট ভাই আব্দুল হান্নানের বয়স চার বছর হবে। এমন অবস্থায় আমাদের দুর্বিসহ জীবন নিয়ে আমাদের মা আনোয়ারা বেগম আমাদেরকে মানুষ করেছেন। আমাদের দাবি আমার আব্বাকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। তার নামে নামকরন করা হোক রাস্তা বা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যারা আমার আব্বাকে হত্যা করেছে বা এ হত্যার পিছনে মদদ দিয়েছিল তাদের বিচার দাবী করছি।
এদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময় পার হলেও শহীদ স্বীকৃতি না পাওয়া বা তার হত্যাকান্ডের কোনো বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেবহাটার কুলিয়া ইউনিয়নের সাবেক কমান্ডার আব্দুল গফ্ফার, বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ।
তারা বলেন, কুলিয়ার কুখ্যাত রাজাকার তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল গফ্ফার ও তার ছেলে আব্দুল জলিল ১৯৭১ সালে ২ জুলাই শুক্রবার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে তাকে তুলে দেন। মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোষররা আলীপুর দীঘিরপাড়ে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এ হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি।
দেবহাটার কুলিয়া ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আসাদুল ইসলাম বলেন, তাকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সংশ্লিষ্টদেও প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)