অবাক করা অবিবাহিত জীবন সুরসম্রাজ্ঞী লতার ।। মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের শোক
ভারতীয় উপমহাদেশের সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর আর নেই। টানা প্রায় চার সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর সকাল সোয়া ৮টার দিকে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।
তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
তার মৃত্যুতে ভারতে দুই দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন।
শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল শনিবার সকালে এ সংগীতশিল্পীকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে নেওয়া হয়। তখন চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, কিছুটা সাড়া দিচ্ছেন লতা। তার বিভিন্ন থেরাপি চলছিল। কিন্তু সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তার।
শেষ হলো ৯২ বছরের পথচলা কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কর্মময় জীবন। চলে গেলেন উপমহাদেশের সংগীতের এই প্রবীণ মহাতারকা। সাত দশক ধরে দর্শক ও সমালোচকদের হৃদয় তৃপ্ত করে চলা ভারতীয় সংগীতের এই কিংবদন্তি ১৯২৯ সালে ভারতের ইন্দোরে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার সংগীত ভারত ছাপিয়ে তাকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বসংগীতের দরবারে।
ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৪২ সালে, মারাঠি গান গেয়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম হিন্দি সিনেমার জন্য গান করেন। বসন্ত জোগলেকরের ‘আপ কি সেবা মে’ ছবিতে তিনি ‘পা লাগু কার জোরি’ গানটি গেয়েছিলেন। দুই বছর পর সুরকার গুলাম হায়দার তাকে প্রথম বড় সুযোগ দেন।
লতা মঙ্গেশকর শুধু সর্বকালের অন্যতম সেরা কণ্ঠশিল্পী নন, তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র ও সংগীতশিল্পের অন্যতম সেলিব্রিটিও ছিলেন। পেশাগত জীবনে অগণিত পুরস্কার, ট্রফি, প্রশংসায় ভেসেছেন।
কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন অবাক করার মতো ছিল। কারণ, তিনি সারা জীবন অবিবাহিত ছিলেন।
যদিও তিনি নিজে কখনো এ বিষয়ে মুখে তেমন কিছু বলেননি, কিন্তু বলিউড শাদিজ ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে এই নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে লতা মঙ্গেশকরের জীবনের শেষ পর্যন্ত বিয়ে না করার সিদ্ধান্তের পেছনে দুটি প্রধান কারণের কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের বিয়ে না করার সিদ্ধান্তের পেছনে দুটি প্রধান কারণ আছে। প্রথমটি একটি সুপরিচিত সত্য যে ছোটবেলা থেকেই তিনি তার ভাই-বোন, মীনা, আশা, ঊষা এবং হৃদয়নাথের প্রতি খুবই স্নেহপ্রবণ ছিলেন। তাদের শিক্ষা থেকে শুরু করে নিজ নিজ ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করতে লতা প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন। এভাবেই তার জীবনের বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়েছে, দশকের কর দশক কেটে গেছে। কিন্তু, তিনি বিয়ে করেননি। তিনি যখন বিবাহকে আলিঙ্গন করার কথা ভাবলেন তখন ভাগ্য দেবী তার সহায় হলেন না।
একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, লতার ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন প্রয়াত ক্রিকেটার এবং ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিসিআই) প্রাক্তন সভাপতি রাজ সিং দুঙ্গারপুর। প্রাক্তন এই ক্রিকেটার রাজস্থানের রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন এবং দুঙ্গারপুরের তৎকালীন শাসক প্রয়াত মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংজির কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন।
হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর এবং রাজ সিং দুঙ্গারপুর সত্যিই ভালো বন্ধু ছিলেন। তাদের বেশিরভাগ আড্ডা হতো হৃদয়নাথের বাড়িতে। সেখানেই রাজ সিং বন্ধুর বড় বোন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। রাজ সিং এবং লতার কয়েকবার দেখা করার পর একে অপরের প্রেমে পড়েন। আরও জানা যায়, রাজ সিং লতা মঙ্গেশকরকে ‘মিঠু’ নামে ডাকতেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, লতা মঙ্গেশকর এবং রাজ সিং দুঙ্গারপুর দুজনেই বিয়ে করার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু, তিনি যখন তার বাবা-মাকে এই বিষয়ে জানান তখন তার বাবা, মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংজি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর পিছনে কারণ ছিল লতা কোনো রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন না। তাই মহারাওয়াল লক্ষ্মণ তার ছেলে রাজ সিংকে একটি সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করতে দিতে পারেননি।
মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংজির দৃঢ় সিদ্ধান্ত রাজ সিং দুঙ্গারপুর এবং লতা মঙ্গেশকরের স্বপ্নের দুর্গটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভেঙে দিয়েছিল। বাবার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার কারণে পিতার সিদ্ধান্ত মেনে নেন তিনি। কিন্তু, রাজসিং তার পুরো জীবনে কাউকে বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেন এবং সেই কথা বাবা-মাকেও এ কথা জানিয়েছিলেন। যাই হোক, লতা মঙ্গেশকরও একই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং দু’জনেই আজীবন বন্ধু ছিলেন।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রাজ সিং দুঙ্গারপুর আলঝাইমার রোগের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মুম্বাইয়ে মারা যান। হয়তো তাদের প্রেমের গল্পটির সর্বোত্তম সমাপ্তি ছিল না। তবে, শেষ পর্যন্ত দু’জন যেভাবে প্রতিজ্ঞা মেনে চলেছেন তা আজকের সময়ে অবশ্যই বিরল।
তবে, লতা মঙ্গেশকর এবং রাজ সিং দুঙ্গারপুর তাদের সম্ভাব্য সম্পর্কের খবরে কখনো কোনো কথা বলেননি বা প্রতিক্রিয়া জানাননি।
যেমন ছিলেন বলিউডি মিউজিকে তার রাজত্ব:
ষাটের দশকে উপহার দিলেন ‘পিয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’ বা ‘আজিব দাসতা হ্যায় ইয়ে’ এর মতো এখনও পর্যন্ত তুমুলভাবে বিখ্যাত সব গান।
লতার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। লতা মঙ্গেশকর একের পর এক হিট গান উপহার দিয়েই চলেছেন। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে লতা গাইলেন‘ জিয়া বেকারার হ্যায়’; যা উতলা করে দিয়েছিলো শ্রোতাদের মন ৷ ১৯৫৫ সালে ‘মন দোলে মেরা তন দোলে’ দুলিয়েছিলো শ্রোতা হৃদয়, ৫৭-তে ‘আজারে পরদেশী’ ডাক দিল দুনিয়ার সঙ্গীত রসিকদের।
খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে গেলেন কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর । ক্রমাগত সুপার ডুপার হিট বহু গানের দৌলতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মাথায় তুলে নিলো লতাকে । সঙ্গীত পরিচালকদেরও নয়নের মণি হয়ে উঠলেন তিনি।
গানের ভাব অনুযায়ী গায়কীকে তৈরি করে নেওয়ার আশ্চর্য দক্ষতা ছিলৈ লতার। একই ছবিতে তিনজন নায়িকার কণ্ঠে গান গেয়েছেন লতা, গাইবার ভঙ্গি প্রতিক্ষেত্রেই পাল্টে নিয়েছেন তিনি।
নার্গিসের মতো প্রায় প্রৌঢ় নায়িকার কণ্ঠে যিনি মানানসই, সেই লতার কণ্ঠ অবলীলায় মিলে যায় ‘ ববি’র কিশোরী ডিম্পলের সঙ্গে। শিশুকণ্ঠের গান , বিরহের বা উচ্ছ্বাসের গান, শিশুকে ঘুম পাড়ান মায়ের গান, প্রেমের গান, ভক্তিমূলক গান যাই হোক না কেন সিকোয়েন্সের সব পুরোপুরি মিটিয়ে প্রার্থিত ভাবটি অতি নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন কিন্নরকণ্ঠী লতা।
১৯৬৩ সাল; ভারত-চীন যুদ্ধে লিপ্ত, জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈন্যরা। লতা গাইলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জওহরলাল নেহরু। সত্তরের দশকে শত শত গান সৃষ্টির সাথেই কনসার্ট করেছেন দেশে-বিদেশে, তাদের অনেকগুলো আবার চ্যারিটিও। থেমে থাকেনি সময়, থেমে থাকেননি লতা। তার এত এত সৃষ্টির ফলে অনায়াসে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সর্বোচ্চ সংখ্যার গান রেকর্ডকারী হিসেবে তার নাম আসে। পরে অবশ্য তার এই রেকর্ড ভেঙেছিলেন নিজেরই ছোট বোন আশা ভোঁসলে। মোট ৩৬টি ভাষায় রচিত তার এই গানগুলোর অনেকগুলো ভাষা তিনি আসলে জানতেনই না। তার মধ্যে বাংলা গানও আছে।
২০০১ সালে লতা মঙ্গেশকর ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ভারতরত্ন অর্জন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
তার কাজের গুনের বাহার:
কয়েক দশক ধরে লতা শুধু যে সঙ্গীতের সাধনা করে গেছেন তাই নয়, ধীরে ধীরে এক অসাধারণ সঙ্গীত শিল্পী থেকে নিজেকে করে তুলেছেন কিংবদন্তি। সঙ্গীত পরিচালকদের একাধিক প্রজন্মের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে কাজ করে গেছেন তিনি। আর তাই নতুন শতাব্দীতে এসেও তিনি একই রকম প্রাসঙ্গিক ছিলেন। তার গুণগান করার জন্য নওশাদ আলী থেকে এ আর রহমান পর্যন্ত সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকেন। মহম্মদ রফি, হেমন্তকুমার, কিশারকুমার, শামশাদ বেগম, আশা ভোঁসলে, মুকেশ, তালাত মেহমুদ, মান্না দে-র মতা সহশিল্পীরাও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন।
তিনটি জাতীয় পুরস্কার, ১৫টি বিএফসে পুরস্কার, ৪টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ছাড়াও পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফলকে পুরস্কারের পর ২০০১ সালে তিনি অর্জন করেন ভারতরত্ন সম্মান। ২০০৭ সালে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ নাগরিক সম্মান ‘লিজিওন অফ অনার’ এও ভূষিত হন তিনি।
এত সব অর্জনের পরও লতা মঙ্গেশকর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি মনে করতে পারেন না কোনটি তার জীবনের সেরা গান, সেরা মুহূর্ত। গানটাই যেন তার জীবনের এক অন্য যাত্রাপথ।
তিনি বলেছিলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে আরেকটু যত্নবান হওয়া দরকার ছিল, আরও কিছু কাজ করা বাকি ছিল তার। সেই বাকি কাজগুলো তার অসমাপ্তই রয়ে গেল।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)