করোনা ভাইরাস
নমুনা প্রদান কমেও সংক্রমিত বেশি, ধারণক্ষমতার তিনগুণ রোগী হাসপাতালে


বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসে টালমাটাল গোটা দেশের হাসপাতালগুলো। নমুনা প্রদান ও পরীক্ষা কম হলেও সংক্রমন অত্যন্ত বেশি। গত বছরের তুলনায় ৭০ ভাগ বেশি সংক্রমিত হচ্ছে এ বছরে। দেশের হাসপাতালগুলোতে ধারণক্ষমতার তিনগুণ রোগীর আনাগোনা। স্থান পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
গত বছরের তুলনায় সারা দেশের উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চলতি সময়ে সাধারণ মানুষ নমুনা প্রদান কম করছেন। অর্থাৎ প্রান্তিক পর্যায়ে নমুনা প্রদান কমে গেলেও যারা দিচ্ছেন তাদের মাঝে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এক কথায় পরিসংখ্যানে গেলো বছরের তুলনায় বর্তমানে করোনার নমুনা প্রদান তথা পরীক্ষা কমে গেলেও সংক্রমণ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশে বর্তমানে যে সংখ্যায় মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, তার ৮১ শতাংশই দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবির গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। ফলে করোনা ভাইরাসের এই ধরন বাংলাদেশে নতুন আতঙ্ক হিসেবে হাজির হয়েছে।
দেখা গেছে, গত বছরের শেষ ভাগে করোনা ভাইরাসের যে নতুন ধরনটি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবার শনাক্ত হয়েছিল, সেই ধরনই মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।
এদিকে দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত এক দিনে আরো ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা মহামারির শুরু থেকে এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা রাজধানীতে বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, গত বছরের চেয়ে বর্তমানে ৭০ ভাগ বেশি সংক্রমিত হচ্ছে করোনা। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন গুণ রোগীর চাপ দেখা যাচ্ছে। ফলে বিপুলসংখ্যক রোগীর বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীর যেসব স্থানে করোনার সংক্রমণ বেশি, সেসব অঞ্চলে প্রয়োজনে কারফিউ দিতে হবে। নইলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পাবে। আইসিডিডিআরবি তাদের ওয়েবসাইটে গত বুধবার গবেষণার এক খবরে জানিয়েছে, তারা ডিসেম্বর মাস থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরের সঙ্গে মিলে করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের ওপর নজরদারি শুরু করে। ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে ১৬ হাজার ২৬৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৫১টি নমুনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। তাতে ৬ জানুয়ারি প্রথম দেশে করোনার ব্রিটেনের ধরনটি শনাক্ত হয় এবং মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই ধরনই বাংলাদেশে বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে দেখা যায় যে, অন্য যেসব ধরন পাওয়া গেছে বাংলাদেশে, তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আইসিডিডিআরবি বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব বাংলাদেশে ভাইরাস প্রসারের ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন আনে। মার্চের চতুর্থ সপ্তাহেই দেখা যায়, দেশে শনাক্ত ধরনগুলোর মধ্যে এখন ৮১ শতাংশই এই ভ্যারিয়েন্ট।
করোনা ভাইরাসের নানা ধরনের মধ্যে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট ও ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টই সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে সবচেয়ে বেশি। আইসিডিডিআরবি বলছে, এই তিনটি ধরনের সংক্রমণের হার বেশি এবং এদের জিনগত পরিবর্তনও ঘটে বেশি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের শনাক্ত হওয়ার হার খুব দ্রুত বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে শনাক্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুও। আর সেজন্যই ধারণা করা হচ্ছিল যে সংক্রমণের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়তো হয়েছে। চিকিত্সকেরা বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে যারা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সঙ্গে আগে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রথম দফার তুলনায় এবারে রোগীদের একটি অংশের মধ্যে অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ার প্রবণতা চিকিত্সকেরা দেখতে পাচ্ছেন। বিশেষ করে ৫০ ভাগ ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর রোগী জানতে পারছে যে, তার করোনা হয়েছে। অনেককে আক্রান্ত হওয়ার ছয়-সাত দিনের মধ্যেই উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দিতে হচ্ছে এবং তা-ও আবার সেটি তুলনামূলক দীর্ঘ সময়, যেমন ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে।
নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা একটু খারাপ হলে তা দ্রুতই আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। আগে আইসিইউতে কোনো রোগী এলে বেশির ভাগকেই ৮-১০ দিনের মধ্যে রিকভারি করে কেবিনে পাঠানো হতো। কিন্তু এবার সেটি হচ্ছে না। এবার অনেক দীর্ঘ সময় লাগছে এবং আইসিইউ থেকে অনেকে আবার ফিরতেও পারছেন না। অনেকেরই ফুসফুস দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে এবং রক্ত জমাট বাঁধছে। বর্তমানে করোনা রোগীদের মধ্যে কারো কারোর রক্তের অণুচক্রিকার সঙ্গে হিমোগ্লোবিনও কমে যাচ্ছে। অথচ গত বছর প্রথম দফার সংক্রমণের সময় অনেকের রক্তের অণুচক্রিকা কমলেও তখন হিমোগ্লোবিনের সমস্যা রোগীদের মধ্যে ছিল না।
হাসপাতালে সিট খালি নেই:
বর্তমানে করোনায় শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। সর্দি-কাশি, জ্বর ও ডায়রিয়া নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে শিশুদের মৃত্যুর হার কম। তবে সব বয়সি মানুষ ব্যাপক হারে করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় রাজধানীর কোনো হাসপাতালে সিট খালি নেই। আইসিইউয়ের জন্য চলছে হাহাকার। পরিস্থিতি এমন যে, চিকিত্সাধীন কোনো রোগী মারা গেলেই কেবল সিট পাওয়া যাবে। অনেকে পাঁচ-ছয় দিন অপেক্ষা করেও আইসিইউ বেড পায়নি। রাতে সরকারি হাসপাতালে সাধারণত শীর্ষ কর্মকর্তারা থাকেন না। এই সুযোগে তখন ওয়ার্ড মাস্টার ও ওয়ার্ড বয়রা আইসিইউ বেড বেচাকেনা করে।
করোনায় মারা যাওয়া একজন রোগীর ছেলে জানান, আইসিইউতে বেড পাওয়ার তালিকায় তার বাবার নাম ছিল এক নম্বরে। তবে পাঁচ দিন চেষ্টা করেও আইসিইউ বেড পাইনি। অথচ রাতে চোখের সামনে দেখি, ওয়ার্ড বয় আইসিইউ বেড বেচাকেনা করছেন। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে ওয়ার্ড বয় বলে, ওয়ার্ড মাস্টার স্যার যাকে বলবেন তাকে আইসিইউ বেড দেওয়া হয়। সাবেক এমপি বিশিষ্ট অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপের ফলে একটি আইসিইউ বেড পান তিনি।
এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, লকডাউন হলো করোনা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। মানুষের জীবন রক্ষার্থে সব দেশের সরকার লকডাউন দেয়। দেশে সাত দিনের লকডাউন দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। কেউ কেউ লকডাউনের বিরুদ্ধে মিছিল সমাবেশ করেছে। এর চরম মূল্য দিতে হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সারা পৃথিবী লকডাউন দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। আমাদের দেশে সাত দিন লকডাউন দেওয়া হলেও তা কার্যকর করা যায়নি। তবে যেটুকু কাজ হয়েছে তাতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া কোনো উপায় নেই। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা রোগীকে দ্রুত সুস্থ করতে বর্তমানে যে চিকিত্সা ব্যবস্থাপনা রয়েছে, এর সঙ্গে কিছু সংযুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তিনি বলেন, সবার স্বাস্থ্যবিধি মানতে যা যা করার তাই করতে হবে।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, গণপরিবহন চলছে, শপিংমল খুলেছে। কেউ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। যে হারে বাড়ছে তাতে সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গ্যাস্ট্রোলিভার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল হাসপাতালে সিট না পাওয়ার চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমি নিজে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ বদরউদ্দিন ওমর ও তার স্ত্রীকে হাসপাতালে সিট দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফি আহমেদ বলেন, শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। সর্দি, জ্বর, কাশি উপসর্গ নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে তাদের মৃত্যু হার কম।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ড. সমীর সাহা বলেন, করোনার বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আমরা জানুয়ারি থেকে বিষয়টি লক্ষ্য করছি। আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট গত মার্চ থেকে বেশি উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই ভাইরাসের এত সক্ষমতা যে, এক জন থেকে আরেক জনের দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। এটা দেশে হয়তোবা আগামী দুই এক মাস স্থায়ী হতে পারে।
শনাক্ত ৭ হাজারের নিচে:
এদিকে গত এক দিনে নতুন রোগী শনাক্ত হওয়ার সংখ্যা ৭ হাজারের নিচে নেমেছে; গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৬ হাজার ৪৫৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। গত এক দিনে মৃত ৭৪ জনকে নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মোট ৯ হাজার ৫২১ জনের মৃত্যু হলো। আর নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৬ লাখ ৬৬ হাজার ১৩২ জন হয়েছে। গতকাল নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত এক দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৪৮ জন পুরুষ আর নারী ২৬ জন। মৃতদের মধ্যে ৪৬ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। ৭৪ মৃত্যুর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৪৩ জন। করোনা ভাইরাসে দেশে মোট মৃত ৯ হাজার ৫২১ জনের মধ্যে ৭ হাজার ১৩০ জন পুরুষ ও ২ হাজার ৩৯১ জন নারী।
তথ্যসূত্র: ইত্তেফাক

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
