সাতক্ষীরায় ৯ মাসে ৬ শিশু হত্যা : নেপথ্যে কি?
বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, সামাজিক কুসংস্কার, দারিদ্র্য ও বিচার না হওয়ায় সাতক্ষীরা বেড়েছে শিশু হত্যা। গতবছর অক্টোবর মাস থেকে চলতি জুলাই মাসে ১৫ তারিখ পর্যন্ত সাতক্ষীরায় পারিবারিকভাবে হত্যার শিকার ৬টি শিশু আলোচনা এসেছে। এছাড়াও রাস্তার পাশ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় আরও এক শিশুকে। নিহত শিশুদের মধ্যে অধিকাংশই কন্যা।
গত ১৩ জুলাই-২১ মঙ্গলবার আশাশুনি উপজেলার কুল্যা ইউনিয়নের গুনাকরকাটি ব্রিজের উপর থেকে একটি শিশুকে ফেলে দেওয়া হয়। শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করলেও তার মাথায় প্রচন্ড আঘাতের কারণে রক্তক্ষরণ হয়। তাকে ভর্তি করা হয় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তারদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ৫ ঘন্টা পর নবজাতক শিশুটি মারা যায়। ঘটনা সাথে জড়িতদের পরিচয় পাওয়া গেলেও আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়নি।
এর আগের ১২ জুলাই-২১ সোমবার সাতক্ষীরা শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জে পারশেখালী গ্রামের পুকুর থেকে ১মাস বয়সী শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওইদিন দুপুরে শিশুটির মা আফরোজা খাতুন ঘুমিয়ে পড়লে তাকে কে বা কারা পুকুরে ফেলে দেয় বলে জানানো হয়। পুকুর থেকে শিশুটির মরাদেহ উদ্ধার করা হলেও ঘটনার কোন ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
এর আগে চলতি বছরের ১ এপ্রিল সাতক্ষীরার কলারোয়ার লাঙ্গলঝাড়ায় সন্তানের যৌন নির্যাতনের বিচার না পেয়ে দুই ছেলে-মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছেন মা মাহফুজা খাতুন (৩২)। নিহত দুই শিশু হলো, মাহফুজ (৯) ও মোহনা (৫)। এঘটনায় মামলা দায়ের করা হলেও আজও পর্যন্ত কোন আসামী গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
চলতি সালের ২ জুন সাতক্ষীরায় তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের চতুর্থ সন্তান মেয়ে হওয়ায় স্বামী ভৎসনা জন্য আট দিন বয়সী পুকুরে ফেলে হত্যা করা হয়। হত্যার অভিযোগে মাকে আটক করলে, তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
২০২০ সালে ২৮ নভেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হাওয়ালখালীতে অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুকে হত্যা করে বাবা-মা। ১৫ দিন বয়সী ওই শিশুর লাশ বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় ওই শিশুর বাবা-মাকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ওই শিশুর হত্যার দায় স্বীকার করে তার বাবা-মা।
এ ছাড়াও ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কালিগঞ্জ উপজেলার গোলখালী এলাকার রাস্তার পাশে একটি ব্যাগের মধ্যে থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। গোলখালী এলাকার মৎস্য চাষি ইসরাইল বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার ও পঞ্চানন মন্ডল মৎস্য ঘেরে যাওয়ার গোলখালী মহাশ্মশান থেকে ১০০ গজ দূরে রাস্তার পাশে আবর্জনাযুক্ত জায়গায় একটি কাপড়ে মোড়ানো ব্যাগের ভেতর থেকে একটি নবজাতক ছেলে শিশুকে উদ্ধার করেন। তাৎক্ষণিক তারা নবজাতক শিশুটিকে উদ্ধার করে প্রথমে কালিগঞ্জ সার্জিকাল ক্লিনিক পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে ভর্তি করেন। ডাক্তারের ভাষ্য মতে আবর্জনা থেকে উদ্ধার হওয়ার ৩-৪ ঘণ্টা আগে শিশুটির জন্ম। এই ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ শিশুটিকে দত্তক নেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেন। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৯ জন লিখিতভাবে আবেদন করেছিলেন শিশুটিকে নিজের কাছে পেতে।
এ বিষয়ে এড. ফাহিমুল হক কসিলু বলেন, করোনার কারনে মানুষ অনেকটা ঘর মুখি। আবার অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে সে কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। আবার এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত না হওয়া এবং দৃষ্টান্তমূলক শস্তি না হওয়ায়ও এসব হত্যার ঘটনা বাড়ছে।
তিনি এসব ঘটনায় সুনিদিষ্ট মামলার মাধ্যমে সঠিক বিচারের দাবি জানিয়ে আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কোনো অবিবাহিত মেয়ে অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা আইন তুলে নেন নিজেদের হাতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা আর তার সন্তানকে খুন হতে হয়। বর্তমানে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াচ্ছে মানুষ, বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে আমাদের ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন আছে, তারা পশ্চিমা সিনেমা দেখছে। কখনো কখনো তারা সমাজের নিষেধ না মেনে প্রেমে জড়াচ্ছে, যা খুশি তাই করছে। কিন্তু পরিবার যখন বিষয়টি জানতে পারছে, ততদিনে হয়ত মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। সামাজিক কুসংস্কার ও দারিদ্র্যের কারণেও হত্যার শিকার হচ্ছে শিশুরা। বিশেষ করে কন্যা শিশুরা কুসংস্কারের বলি হচ্ছে। সব মিলিয়ে সাতক্ষীরায় শিশু হত্যার ঘটনাগুলো সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)