প্রদীপের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তার ভাগ্যে জুটতো ‘ক্রসফায়ার’
কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর উঠে আসছে ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতের নানা অপকর্মের তথ্য। জানা গেছে, প্রদীপের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারতেন না এতোদিন। বললেই তার ভাগ্যে জুটতো ‘ক্রসফায়ার’, নয়তো মামলা কিংবা নির্যাতন।অপরদিকে, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ওই তদন্ত কেন্দ্রে যোগদানের সাত মাসের মধ্যেই এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদক ব্যবসায়ী ও মানবপাচারের অভিযোগ তুলে অনেকের কাছ থেকেই চাঁদা আদায় করতেন তিনি। এছাড়া এলাকার বেশ কয়েকটি ফিশারিজ ঘাট থেকেও নিয়মিত মাসোয়ারা আদায় করতেন। পাশাপাশি প্রদীপের মতো টাকা নেয়ার পরও ক্রসফায়ারে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে লিয়াকতের বিরুদ্ধে।
এর আগে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে টাকা না পেয়ে উল্টো তাকে নানা নির্যাতনের পাশাপাশি বন্দুকযুদ্ধে নেয়ার চেষ্টাও করেন লিয়াকত। অপকর্মের কারণে তার নামে আছে বিভাগীয় মামলাও।
প্রদীপের হাত থেকে রেহাই পাননি গণমাধ্যমকর্মীরাও। তার বিরুদ্ধে সংবাদ করায় পৃথিবীর আলো দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ফরিদুল মোস্তফা খান নামে এক সাংবাদিক। কোনো অপরাধ না করেও এখনো কারাবন্দী মাসের পর মাস। ফরিদুল মোস্তফা খান ‘দৈনিক কক্সবাজার বাণী’ এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘জনতার বাণী ডটকম’র সম্পাদক ও প্রকাশক। প্রদীপ কুমার দাশের নির্যাতনে চোখ হারিয়েছেন তিনি। থানা হাজতে তো নয়ই, কারাগারে নেয়ার পরও ফরিদুল কোনো চিকিৎসা না পেয়ে আজ পঙ্গু। ১১ মাস ধরে ছয়টি মিথ্যা মামলায় বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছেন এই সংবাদকর্মী। কারাবন্দী জীবনে কোনো রকম বেঁচে আছেন ফরিদুল। তার ওপর নির্মম এ নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে কেউ সংবাদ প্রকাশ করতেও সাহস পাননি।
২০১৯ সালের ২৪ জুন ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করেন ফরিদুল মোস্তফা খান। এরই জেরে একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে ফরিদুলকে আটক করা হয়। এরপর টেকনাফ থানায় এনে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালান প্রদীপ কুমার। দুই চোখে দেয়া হয় মরিচের গুঁড়া। বর্তমানে দুটি চোখই নষ্ট হওয়ার উপক্রম। এছাড়া ফরিদুল মোস্তফার হাত-পা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন ওসি প্রদীপ। এতেও ক্ষান্ত হননি তিনি, ইয়াবা ব্যবসায়ী সাজিয়ে ফরিদুল মোস্তফা খানকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই মামলায় জামিনের ক্ষেত্রেও নানা প্রভাব ও কূটকৌশল খাটিয়ে বাধার সৃষ্টি করে নির্যাতিত সাংবাদিককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন প্রদীপ।
এছাড়াও মানবপাচারকারী সাজিয়ে দুই দিনমজুরকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে। মাঝরাতে ঘর থেকে তুলে নেয়ার সময় পরিবারকে কবর খুঁড়ে রাখতে বলেন। নিহতদের স্বজনরা এসব অভিযোগ করেছেন।
ফরিদা। যার স্বামী ও ভাইয়ের প্রাণ গেছে কথিত বন্দুকযুদ্ধে। টেকনাফ থানায় গিয়ে অভিযোগ করছিলেন তিনি। টেকনাফের টেকের পাড়ায় পরের জমিতে ঘর তুলে থাকতেন রাজমিস্ত্রি আব্দুর রহমান। টানাটানির সংসার তার। তারপরও অসহায় এক রোহিঙ্গা পরিবারকে একবেলা ভাত খাইয়েছিলেন। দু’দিন পরই গত বছরের ২৫ জুন সদলবলে আসেন টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
পরিবারের দাবি, তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় আব্দুর রহমানের স্ত্রীকে স্বামীর কবর খুঁড়ে রাখার পরামর্শ দিয়ে যান ওসি প্রদীপ। আব্দুর রহমানের স্ত্রী বলেন, ‘৭-৮ জন ঘরে ঢুকে আমার স্বামীরে ধরে নিয়ে গেছে। আমার স্বামীরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন এ কথা জিগাইতে বলে ‘তোমার বাড়িতে কবরস্থান থাকলে খুঁড়ে রেখো’। তখন পুলিশ বলে তোমার স্বামীরে মেরে ফেলবো, কাল রাতে ৪ জনকে মারছি। আজকে তোমার স্বামীকে মারবো।’
সে রাতেই আব্দুর রহমানের বোন ফরিদা ও তার স্বামী আব্দুল কাদেরকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দু’জন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। কাদেরের স্ত্রীর অভিযোগ, জেলে নেয়ার আগে থানার মুন্সি তার গলার চেইন ছিনিয়ে নেন।
এদিকে, প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকীর নামে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই সম্পদ অর্জনের বৈধ উৎস দেখাতে না পারায় প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে দুদক মামলা করতে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোডে, শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে মারা যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ সিনহা। এঘটনায় বুধবার (৫ আগস্ট) টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকতসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে কক্সবাজার আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রাশেদ খানের বড়বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটি তদন্তের জন্য র্যাবকে নির্দেশ দেন আদালত।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)