বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

কলারোয়া নিউজ

প্রধান ম্যেনু

সাতক্ষীরা, দেশ ও বিশ্বের সকল সংবাদ, সবার আগে

ইতিহাস ঐতিহ্য-১

জনপদের নাম কলারোয়া : সাতক্ষীরা মহকুমার প্রথম সদর দপ্তর

ইতিহাস ঐতিহ্য-১

জনপদের নাম কলারোয়া : সাতক্ষীরা মহকুমার প্রথম সদর দপ্তর

প্রফেসর মো. আবু নসর

বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে সীমান্তবর্তী শস্য-শ্যামলা প্রশান্ত ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশে কলারোয়া উপজেলার অবস্থান। দেশের বহুল উচ্চারিত জনপদের নাম সাতক্ষীরার কলারোয়া।

১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরা মহাকুমা সৃষ্টি হওয়ার পর মহকুমার সদর দপ্তর কলারোয়ায় স্থাপিত হয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত এবং অগ্রগামী ছিল, বিধায় কলারোয়াতেই সাতক্ষীরা মহাকুমার প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। তাই উপমহাদেশের ইতিহাসে কলারোয়ার স্থান অত্যন্ত গৌরবজনক। নবগঠিত মহাকুমার প্রথম মহাকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব আব্দুল লতিফ (ফরিদপুর)। যিনি পরবর্তীতে খান বাহাদুর উপাধি লাভ করেন।
অবশ্য কলারোয়ায় ১০ বছর যাবৎ মহাকুমার প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানোর পর ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরার প্রভাবশালী জমিদারের প্রচেষ্টায় মহকুমা সদর দপ্তর সাতক্ষীরা সদরে স্থানান্তরিত হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কলারোয়াতে কার্যালয় স্থাপন করে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে সাতক্ষীরাকে যশোর জেলার চতুর্থ মহাকুমা হিসেবে সৃষ্টি করা হয়। পরে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ২৪ পরগনা জেলা সৃষ্টি হলে সাতক্ষীরা মহাকুমা ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্রকাশ থাকে যে, যশোর জেলা মূলত খুলনা এবং ২৪ পরগনা জেলার অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৮১ সালের ৭ জুন অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা হিসেবে যশোর জেলা গঠিত হয়। ফরিদপুর, ২৪ পরগনার কিছু অংশ, নদীয়া (বর্তমানে কুষ্টিয়া) ও খুলনা নিয়ে যশোর জেলা গঠিত হয়। ১৮০০ সালে যশোর জেলা কালেক্টরেট বিল্ডিং নির্মিত হয়। যশোর জেলার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ট্রীলম্যান হেংকেল।
১৮৮১ সালে খুলনা জেলা গঠিত হয়। মহাকুমা হিসেবে খুলনার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮৪২ সালে।

কলারোয়া উপজেলার আয়তন ৯০ বর্গমাইল বা ২৪৪ বর্গ কিলোমিটার। ১২টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা, ১১৭টি মৌজা ও ১৫৩টি গ্রাম আছে। জনসংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ।

প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বহু পূর্বে কলারোয়ার অপর নাম ছিল হোসেনপুর। পরবর্তীকালে ইংরেজদের ও নীল কুঠিয়ালদের ব্যবসাকেন্দ্র হোসেনপুর কলারোয়া নামে আত্মপ্রকাশ করে। জরিপ মানচিত্রে কলারোয়া বলে কোন স্থান ছিল না। স্থানটির নাম ঝিকরা, মৌজা ঝিকরা।
অবশ্য পুরাতন রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে একটি পরগনার নাম পাওয়া যায় সেটা হলো হোসেনপুর পরগনা। পৃথক হোসেনপুরেরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে স্থানটি একসময় ২৪ পরগনা জেলার কলারোয়া হোসেনপুর নামক একটি পরগনা ছিল।

কলারোয়ার নামকরণের ইতিহাস বিভিন্ন তথ্য উদঘাটনের মাধ্যমে ও প্রবীনদের কাছ থেকে জানা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বর্তমান কলারোয়ার পশুর হাটের উত্তর পশ্চিম পাশের মিলঘরের পিছনে ইংরেজদের নীল কুঠি ছিল। অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের বল্গাহীন নির্যাতন ও শোষণের সময় জমিদার রানী রাশমনির নায়েব ছিলেন শ্রী মোহন ঘটক।
হোসেনপুর পরগনার জমিদার কলকাতার করপোরেশন স্ট্রিটে বসবাস করতেন রানী রাশমনির। রানী রাশমনির বড় মেয়ে রানী জগদম্বাও মায়ের সাথে কলকাতার পিতৃগৃহে একত্রে বসবাস করতেন।
একদা নায়েব শ্রী মোহন ঘটক হিসাব দাখিল করার জন্য সেখানে উপস্থিত হন।
এদিকে নীলকর সাহেবদের অমানুষিক নির্যাতন ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকার বিশেষ বিশেষ লোকজন ও কৃষকরাও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিকার প্রার্থনা নিয়ে জমিদার রানী রাশমনির নিকট উপস্থিত হন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বড় মেয়ে জগদম্বাও। রানী জগদম্বা তখন নায়েব শ্রী মোহন ঘটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা জানতে চান।
উপস্থিত বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ ও কৃষকরা নায়েক সাহেবের কাছে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার ও প্রতিবাদে প্রার্থনা জানালেও কোনো ফল হয়নি বলে জানান। কৃষকরা নায়েবের উপর দোষারোপ করেন। তখন রানী জগদম্বা নৈতিক সাহসের অভাব হেতু কাপুরুষতার জন্য নায়েব শ্রীমোহন ঘটককে তার মুখের উপর পুরুষ মানুষের পরিবর্তে ‘মেয়ে মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
নায়েব মোহন ঘটক নীলকর সাহেবদের এহেন চরম অত্যাচারকে মনে মনে ঘৃণা করতেন। নায়েব একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু মনোবল ও জনবলের অভাবে তিনি সরাসরি কিছু করতে পারতেন না। রানী জগদম্বার কাছ থেকে ‘মেয়ে মানুষ’ উপাধি পেয়ে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে জেদী নায়েব শ্রীমোহন ঘটক মনে মনে দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ হয়ে হোসেনপুর (বর্তমানে কলারোয়া) ফিরে এলেন।
এবার তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং শতাধিক কৃষকদের নিয়ে পরিকল্পনা মোতাবেক নীলকুঠিতে সহসা একদা রাতে অতর্কিত হামলা ও আক্রমণ চালিয়ে নীলকুঠি ভবনটি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে চুরমার করে বিধ্বস্ত করে দিলেন। নীলকর সাহেবরা কোনরকমে পালিয়ে বাঁচলেন। পার্শ্ববর্তী বেত্রাবতী নদীতে ধ্বংসাবশেষ ডুবিয়ে দেয়া হলো। তারপর কয়েকখানা লাঙল চালিয়ে ওই রাতেই ধ্বংসপ্রাপ্ত নীলকুঠি ভবনের উপর চাষ করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে মই দিয়ে মাটি সমান করে অসংখ্য কলা গাছ রুয়ে দেয়া হয়।

অসংখ্য কলাগাছ রোয়ার পর একই রাতে নায়েব শ্রী মোহন ঘটক তার দলবল সহ বত্রিশদাঁড়ি মাঝিমাল্লা নিয়ে ভোরে কলকাতার করপোরেশন স্ট্রিটে জমিদার রানী রাশমনির বাসভবনে উপস্থিত হয়ে সব ঘটনা খুলে বললেন। জমিদার রানী রাশমণি তৎকালীন ছোটলাট এবং বিভাগীয় কমিশনারকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঘটনাটি অবহিত করলেন। হোসেনপুরের নীলকুঠির অস্তিত্ব তখন সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার হোসেনপুর (কলারোয়া) থেকে নীলকুঠি প্রত্যাহার করেন। তবে নীলচাষ বন্ধ হয়নি।

তৎপরবর্তীতে রোপনকৃত কলা গাছের প্রবৃদ্ধি দেখে সবাই মুগ্ধ হলেন। আরো অধিক সংখ্যক নানান জাতের কলা গাছ সেখানে রোপন করা হয়। এই কলাগাছ রুয়া থেকে হোসেনপুর প্রথমে কলারুয়া এবং আরো পরে কলারোয়া নামে পরিচিতির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে।

এভাবেই কলাগাছ রুয়ার ফলে হোসেনপুর থেকে কলারুয়া ও পরে কলারোয়া নামকরণ হয় বলে জানা যায়।

কপোতাক্ষ, বেত্রাবতী, ইছামতি, সোনাই বিধৌত বিভিন্ন তরুরাজির অপরূপ সবুজ শ্যামলিময় সমৃদ্ধ বহু জ্ঞানীগুণী, মেধাবী, বুদ্ধিজীবী, বিদগ্ধ, পীরে কামেল ও আধ্যাত্মিক পুরুষের জন্মস্থান, নীল বিদ্রোহের পীঠস্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দুর্ভেদ্য দুর্গ, মানুষের স্বপ্নরাজ্য ও কর্মস্থান, জাতীয় ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র, স্বপ্নের ইন্দ্রপুরী কলারোয়ার অতীত ও বর্তমান অত্যন্ত ঐতিহ্যমন্ডিত এবং গৌরবময়। উপমহাদেশের ইতিহাসে কলারোয়ার স্থান অত্যন্ত গৌরবজনক বিধায় বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষের এক নন্দিত জনপদ।

পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে হয়-
‘মাথার উপর নীল চাঁদোয়া,
শস্য-শ্যামে গা নাওয়া;
চোখ জুড়ানো মন ভুলানো,
স্বর্গোপমা কলারোয়া’।

 

 

লেখক:
প্রফেসর মো. আবু নসর,
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ,
কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
০১৭১৭০৮৪৭৯৩

একই রকম সংবাদ সমূহ

‘লাইলাতুল কদরে প্রত্যেক বরকতপূর্ণ বিষয় অবতীর্ণ হয়’

‘লাইলাতুল কদরে প্রত্যেক বরকতপূর্ণ বিষয় অবতীর্ণ হয়’ আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসরবিস্তারিত পড়ুন

পাপ মুক্তি ও রহমতের রজনী ‘পবিত্র শবে বরাত’

পাপ মুক্তি ও রহমতের রজনী ‘পবিত্র শবে বরাত’ আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবুবিস্তারিত পড়ুন

বাংলা ভাষার জন্য বাঙালিদের আত্মত্যাগ বিশ্বের দৃষ্টান্ত

বাংলা ভাষার জন্য বাঙালিদের আত্মত্যাগ বিশ্বের দৃষ্টান্ত প্রফেসর মো. আবু নসর ৫২’রবিস্তারিত পড়ুন

  • পবিত্র মিরাজের শিক্ষা স্রষ্টার ইবাদত ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ
  • সাতক্ষীরার প্রথম মহকুমা প্রশাসক নওয়াব আব্দুল লতিফ
  • বহু ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সাক্ষী আশুরা
  • জনসংখ্যার গতি-প্রকৃতি: চীনকে ছাড়িয়ে ভারত
  • ঈদুল আযহা : ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান স্মরণিকা
  • শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের দিন ‘মে দিবস’
  • বরকতময় পবিত্র শবে বরাত
  • ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মূল চালিকা শক্তি
  • চেতনায় ’৭১: মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়া
  • ৬ ডিসেম্বর কলারোয়া হানাদারমুক্ত দিবস প্রফেসর মো. আবু নসর
  • সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী (সাঃ)
  • আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ, আত্মশুদ্ধি-ই হলো কোরবানি