সাগর তীরে কলমী লতা
তারিক ইসলাম “এইতো এখানে প্রণয় কূজনে
মলয় বাঁশরি বাজে,
রঙধনু রঙে চকিত আকাশ
আপন মোহনে সাজে।
ফেনিল জোয়ারে আশাগুলো ভাসে
অধরে মুচকি হাসি,
কানে কানে এসে বলে গেলো কেউ
খুব বেশি ভালোবাসি।
সেই সুখে হাসে সাগর লতারা
হেসে হয় পরবাসী,
যদি ডাকে কানু রাধা রাধা বলে
প্রেম পরবেই ফাঁসি।”
সাগর তীরে কলমী লতা নাম তার সাগর লতা। সাগরলতার গোলাপি-অতিবেগুনি রঙের ফুলে সাগর তীরে এক অন্যরকমের সৌন্দর্য তৈরি হয়। সাগর লতার অনেক গুলো প্রচলিত নাম রয়েছে যেমন : সাগর কলমী, ছাগলখুরী, সাগরলতা স্থানীয়দের ভাষায় ডাউঙ্গালতা কিংবা গঙ্গালতা অথবা পিয়াজলতা। সাগরলতার বহুল প্রচলিত নাম ‘ছাগলখুরী’। সম্ভবত, পাতার কারণেই এমন নামকরণ। পাতার ডগা ছাগলের খুরের মতো বিভক্ত।
সাগরলতার বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea pes-caprea। এটি Convolvulaceae গোত্রের উদ্ভিদ। এটির অন্য সাধারণ নাম বিচ মর্নিং গেস্নারি।আমেরিকায় এ লতাকে railroad vine বলে থাকে।এর ফুলগুলো বড় ও ফানেল আকৃতির, রং বেগুনি থেকে বেগুনি-গোলাপি। পাতাগুলো রসাল এবং বৃত্তাকার খাঁজকাটা টিপের মতো দেখতে। এই টিপ কিছুটা ‘ছাগলের পায়ের’ মতো দেখায় বলে ল্যাটিন ভাষায় এর নাম হয়েছে ‘পেস ক্যাপ্রে’।
সর্বশেষ ১৮১৮ সালে বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন গাছটির প্রজাতি শনাক্তসহ অন্যান্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ সুসম্পন্ন করেন। লতা দ্রুত বর্ধনশীল ও লম্বাটে হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। পাতা একক, পুরু, মসৃণ ও দেড় মিলিমিটার লম্বা হয়। ফুল সাধারণত একক; ফোটে পাতার কক্ষে, বেগুনি রং, ফানেল আকৃতির এবং তিন থেকে ১৬ সেন্টিমিটার দীর্ঘ। গাছ চমৎকার ঔষুধি গুণসম্পন্ন। পাতা ও শিকড় দুর্বলতা কাটাতে, বাতের ব্যথায় এবং কোথাও কোথাও ডায়াবেটিসের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার্য। দেশে এদের ঘনিষ্ঠ প্রজাতি ঢোলকলমি, জলকলমি ও মর্নিং গ্লোরি। সারা পৃথিবীতে এই (আইপোমিয়া) গণে প্রায় ৫০০ প্রজাতির গাছ দেখা যায়।
সাগরের বেলাভূমিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ মানুষের মনকে ভাবনায় ফেলে দেয়। দূর থেকে দূরতর আকাশের নীলের আভায়, সাগরের বিশাল জলরাশির নীলিমায় আত্মহারা হয়ে যায় মন। বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্ত ছুঁয়ে বঙ্গোপসাগরের যে বেলাভূমি আছে, তাতে নানা ধরনের গাছপালার সমাবেশ ঘটেছে। এসব গাছ নোনাজলে ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। এসব গাছপালার মধ্যে সাগরকলমি সহজদৃষ্ট এক বনফুলের লতা। সাগরের বেলাভূমির গা বেয়ে যে লতার বেড়ে ওঠা। পৃথিবীতে এ লতা সমুদ্রপথে অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ, এ লতার বীজ লোনাজল সহনীয় এবং জলে ভেসে থাকে। মহাসাগরীয় বিস্তার যেসব উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, সাগরকলমি তার মধ্যে অন্যতম। আটলান্টিক, প্রশান্ত, ভারত মহাসাগর, নিউসাউথ ওয়েলস, কুইন্সল্যান্ড উপকূল, হাওয়াই দ্বীপ, মেক্সিকো, আফ্রিকা, ফ্লোরিডা উপকূলে আছে এটি।
সাগরলতা সৈকতের অন্যান্য প্রাণী যেমন: বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া ও পাখির টিকে থাকার জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, সাগরলতার সবুজ পাতা মাটিকে সূর্যের কিরণ থেকে এমনভাবে রক্ষা করে, যাতে সূর্যের তাপ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি বাষ্পীভূত করতে না পারে। এতে মাটির নিচের স্তরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াসহ অন্য প্রাণিকুলের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে।
এ ছাড়া সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের শরীর জেলিফিশের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলে সাগরলতার পাতার রস ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে স্থানীয়ভাবে ক্ষত সারানোর জন্য।সাগরলতা না থাকলে বহু প্রাণী পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে।সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বালুর পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরির প্রধান কারিগর এই সাগরলতা। আর এ বালিয়াড়িই ঝড়–জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ থেকে পরম মমতায় আগলে রাখে সমুদ্রসৈকত এবং সমুদ্রতীরের জনগোষ্ঠী ও জীব বৈচিত্রকে।
লেখক : তারিক ইসলাম, সভাপতি সাতক্ষীরা বোটানিক্যাল সোসাইটি।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)