আলোচনায় মোটেও সন্তুষ্ট নই, ভোটের কাট অফ সময় ডিসেম্বর: মির্জা ফখরুল


নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বিএনপি মোটেও সন্তুষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বুধবার দুপুরে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে সাংবাদিককের ব্রিফ করেন বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ জানাননি। তিনি ডিসেম্বর থেকে জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। আমরা বলেছি, ডিসেম্বর নির্বাচনের কাট অফ সময়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ডিসেম্বরেই আমরা নির্বাচন চাই। প্রধান উপদেষ্টা বলেননি যে, ডিসেম্বরে ভোট হবে না। উনি ডিসেম্বর থেকে ছাব্বিশের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন। তবে আমরা পরিষ্কার বলেছি যে, আওয়ার কাট অফ টাইম ইজ ডিসেম্বর। ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোট হতে হবে।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা না দেওয়া বিএনপি অসন্তুষ্ট জানিয়ে দলটির মহাসচিব বলেছেন, তারা বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় ‘একেবারেই সন্তুষ্ট নন’।
প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ না দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির পরবর্তী অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, দল ও মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে ‘আমরা আবার আপনাদের সামনে আসব’।
নির্বাচনের তারিখ প্রলম্বিত করা হচ্ছে বলে মনে করছেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় বলা হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে জুন। ‘তিনি এ কথা বলেননি যে ডিসেম্বরে (নির্বাচন) হবে না। কিন্তু জুন পর্যন্ত (সময়) নিয়েছেন। আমরা এই কথাটা পরিষ্কার করে বলেছি যে আওয়ার কাট অফ টাইম ইজ ডিসেম্বর।’
আগেরবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ‘আশ্বস্ত’ বিএনপি এবার কেন ‘সন্তুষ্ট’ নয়, জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একই প্রশ্ন কেন অন্যভাবে নিচ্ছেন। অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এটাই (নির্বাচন) ছিল মুখ্য বিষয়।’
ফ্যাসিবাদী শাসনের যাতাকলে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে থাকা বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন চাওয়ার পাশাপাশি এ নিয়ে রোডম্যাপ চেয়ে আসছিল। এর মাঝেই ভোট নিয়ে তাদের বক্তব্য ও সরকারের অবস্থান জানতে আজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে যান বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ৮ নেতা।
প্রতিনিধি দলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যরিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং মেজর অব. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
জানা গেছে, বৈঠকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি জানায় বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের ভিন্নমতপূর্ণ বক্তব্যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়েই প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে তারা স্পষ্ট অবস্থান জানতে চান।
আগে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট হবে। তবে সম্প্রতি ড. ইউনূস একাধিকবার বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিএনপি এ বক্তব্যে সন্তুষ্ট নয়। তাদের দাবি, নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা ও রোডম্যাপ প্রকাশ করতে হবে। অন্যথায়, দলটি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে আবারও মাঠের কর্মসূচিতে যেতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির ৮ শীর্ষ নেতা
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন বিএনপি শীর্ষস্থানীয় নেতারা। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গেছেন।
বুধবার দুপুর ১২টার দিকে এ বৈঠক শুরু হয় বলে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান।
এর আগে বিএনপির প্রতিনিধি দল যমুনায় পৌঁছান।
প্রতিনিধি দলের অন্যদের মধ্যে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যরিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং মেজর অব. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
এর আগে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বিএনপি সময় চেয়েছে বলে জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছে বিএনপি। ড. ইউনূসের সঙ্গে আলোচনার পরই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে দল। নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা কাটাতে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা জরুরি বলেও জানান দলটির প্রভাবশালী এই নেতা।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
দুই বৈঠকসহ সার্বিক বিষয়ে মঙ্গলবার রাতে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। লন্ডন থেকে বৈঠকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৈঠক সূত্র জানায়, এতে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে পৃথক দুই বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হবে, তা ঠিক করা হয়।
সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এবং নির্বাচন ঘিরে বিভ্রান্তি দূর করা নিয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া নির্বাচন নিয়ে সরকারের মনোভাব কী, তা স্পষ্ট হওয়ার চেষ্টা করবেন। একই সঙ্গে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও তারা কথা বলবেন।
এছাড়াও সংস্কার ইস্যুতে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে অনেকে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করছেন। সে বিষয়েও প্রধান উপদেষ্টাকে বিস্তারিত ব্যাখা করবে বিএনপি। নেতারা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যদি ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে থাকেন, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কোনো কর্মসূচি দেবেন কি না।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা কাটাতে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা জরুরি। আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয়ে জানতে চাইব।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কাছে পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তিনি সব কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আমরা সেটা জাতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর অনুরোধ করেছিলাম, যাতে জাতি আশ্বস্ত হয়, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি যাতে কোনো ষড়যন্ত্রের সুযোগ না পায়। কিন্তু তিনি এখন নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে করার কথা বলছেন। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে আমরা একমত নই।
বিএনপি নেতারা বলেন, সরকার ছোট সংস্কার ও বড় সংস্কারের কথা বলছে। অথচ সংস্কারের বিষয়টি বিএনপি দেড় বছর আগে ৩১ দফায় ঘোষণা করেছেন। এটি বিএনপির প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সংস্কারের কথা বলে র্কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন হলে তা হবে জাতির জন্য দুঃখজনক। কোনো কোনো দল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সংস্কারের কথা বলে জাতীয় নির্বাচনকে পেছানোর পাঁয়তারা করছে, তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। এসব দলের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে জনগণের চওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে বলব সরকারকে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি যেহেতু এই সরকারকে নানাভাবে সহযোগিতা করছে এবং আগামী দিনেও করবে, সে কারণে নির্বাচনি রোডম্যাপ ইস্যুতে তারা বড় ধরনের কোনো কর্মসূচিতে যেতে চান না।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বাস্তবতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক চাওয়া-এসব বিবেচনায় নিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে। দলটি মনে করে, দ্রুত নির্বাচন হলে দেশে বিদ্যমান নানা সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে এবং দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
সংস্কার নিয়ে কাজ করছেন বিএনপির এমন একাধিক নেতা বলেন, সংস্কার ইস্যুতে বিএনপিকে দোষারোপের চক্রান্ত হচ্ছে। বিএনপি বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি পুনর্বহাল চায় বলে যে গুঞ্জন ছড়ানো হয়েছে, তা দলটিকে একদিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি মতামত দিয়ে পরিষ্কার করেছে, ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানে যে চার মূলনীতি ছিল, তা পুনবর্হাল চায় বিএনপি। এর ব্যাখ্যায় নেতারা বলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে ১৯৭৬ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে সংবিধানের মূলনীতি করেন। আরেক মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র’-এর অর্থ করা হয় সামাজিক ন্যায়বিচার। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে মূলনীতি করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা অনুমোদন করা হয়। ২০১০ সালে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। পরের বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের মূলনীতি ফিরিয়ে আনে। অন্তর্বতী সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংক্রান্ত সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দিয়ে সংবিধানের মূলনীতি হিসাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। বিএনপি এতে একমত নয়। বিএনপি অনুচ্ছেদ ৮, ৯, ১০ ও ১২-কে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থা, অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’কে ফিরিয়ে আনতে মতামত দিয়েছে। এরপরও বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। ২০১১ সালের পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া মানেই ১৯৭৯ সালের মূলনীতিতে ফেরা; বাহাত্তরের সংবিধানে নয়।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি আগে থেকেই বলে আসছে, সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়-এমন প্রয়োজনীয় সংস্কার ঐক্যের ভিত্তিতে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে করা সম্ভব। নির্বাচন আয়োজনে দরকার এমন সংস্কারের জন্য একই পথ অবলম্বন করা যায়। এর জন্য সময়ক্ষেপণের দরকার নেই।

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
