বাংলাদেশে পালাবদল, প্রভাব বিস্তারে ভারতকে কি টেক্কা দেবে চীন?
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত অবস্থায় রয়েছে। কেননা হাসিনার সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং বিরোধী দল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
এই সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত আঞ্চলিক মিত্র হতে পেরেছিল। অন্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ থাকলেও শেখ হাসিনার কারণে বাংলাদেশ ছিল তাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী। পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন ব্যাপকভাবে অন্য দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করলেও বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়নি।
তবে অভিযোগ রয়েছে, বিগত দেড় দশক ধরে ভারত মূলত হাসিনা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে, বাংলাদেশের জনগণের চাওয়াকে তারা উপেক্ষা করেছে। সে কারণেই দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে।
যার ফলে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অনেকের ধারণা, এ প্রেক্ষাপটে উল্টো চীত্র দেখা যাবে চীনের ক্ষেত্রে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষমতার এই পালাবদল ভারতের ক্ষেত্রে যতটা চীন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ততটাই চীনের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বর্তমানে চীন স্বাভাবিকভাবেই চেষ্টা চালাবে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার। যদিও ব্যাপক হারে ঋণ দেওয়ার কারণে ঢাকার ওপর আগে থেকেই প্রভাব রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বাংলাদেশের এই বিপর্যয়ে ভারতকে চাপে রাখা চীনের জন্য খুবই সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে বলে অনেকে মনে করলেও দেশটি ততটাও সফল হবে না বলে মনে করছেন ভারতীয় বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমগুলো।
ভারতীয় কয়েকটি গণমাধ্যম বলছে, হাসিনা সরকার বরাবরই ভারত ও চীন, দুই দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেছে। অবশ্য চীনের সঙ্গে সেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভারতের অনুকূলেই সবসময় ছিল। বাংলাদেশে চীনের অনেক সফল প্রজেক্ট থাকার পরেও ভারতের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে হাসিনা চীনকে সোনাদিয়া ডিপ-সি বন্দরের প্রজেক্টটি দেয়নি।
২০২৪ সালে একতরফা নির্বাচনের পর ভারতের সাহায্যের জন্য পুরোপুরি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন হাসিনা। বাংলাদেশ তিস্তা ওয়াটার প্রজেক্টের জন্য চীনকে পাশ কাটিয়ে ভারতকে বেছে নেয় হাসিনা সরকার। নিরাপত্তার খাতিরে ভারতের বিরোধিতা সত্ত্বেও চীন সেই প্রজেক্টে টাকা ঢালতে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। চলতি বছরে হাসিনার চীন সফরের পরপরই বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ঠান্ডা সম্পর্কের সূত্রপাত।
কেনান চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করা হলেও বেইজিং মাত্র ১৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশকে দেয়। ফলে ক্ষুব্ধ হাসিনা তার চীন সফর সম্পূর্ণ না করেই ফিরে আসেন।
বাংলাদেশে হওয়া এই গণঅভ্যুত্থান, ভারতের উপর চীনের আগ্রাসন অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। চীন বরাবরই আর্থিকভাবে শক্তিশালী একটি দেশ।
বর্তমানে চীন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বেশ সজাগ। আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের বিপুল আর্থিক সংকট এবং ভারত বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি হওয়ার কারণে চীনের বেশ সুবিধা হয়েছে। বাংলাদেশে নতুন সরকারের কুর্শি দখল, চীনকে আরও আগ্রাসী বানানোর জন্য যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে।
শুধুমাত্র ভারতের পূর্বপ্রান্তেই নয়, পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকার ফলে দেশের পশ্চিম প্রান্তেও চীনের আগ্রাসন তৈরি হতে পারে। এরই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরেও তাদের আধিপত্য বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
তেমনই গুরুত্বপূর্ণভাবে, চীনের সঙ্গে মালদ্বীপ হাত মেলানোর ফলে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত আরও কোণঠাসা হয়ে উঠবে সঙ্গে বৃহত্তর ভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতিতে চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলার জন্য ভারতের পক্ষে চাপেরও হবে। কিন্তু চীনের পক্ষেও পুরো সুবিধা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভাতীয় বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা, বিকল্প রাজনৈতিক দলের অভাব, আওয়ামী লীগের নেতাদের ক্ষমতা হ্রাস সঙ্গে গোটা দেশের দখল ছাত্রদের হাতে চলে যাওয়ায় চীনের পক্ষে গোটা বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার অত্যন্ত কঠিন হবে।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার চায়, যারা তাদের দাবি দাওয়া রাখবে। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের সরকারের সঙ্গে চীন সরকারের সম্পর্ক মোটের ওপর ভালোই ছিল। যার ফলে বাংলাদেশে চীন নিজেদের বিভিন্ন প্রজেক্ট শুরু করায় কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি।
নিউজ১৮ বলছে, বাংলাদেশে ক্রমশ ইসলামিক আন্দোলনের পরিধি বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে সরকার গঠনে বড় ভূমিকা নেবে, যা চীনের পক্ষে অসুবিধার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। চীনের মন্ত্রণালয়ের পক্ষেও যা আশাব্যঞ্জক নয়।
তাদের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট আরও একটি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের কাছে। এর ফলে, বাংলাদেশকে চীনের থেকে বড় অঙ্কের লোন নিতে পারে, যা তাৎক্ষণিক অভাব মেটালেও, দেশের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব, যা বাংলাদেশে চীনা প্রভাবে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র বরাবর হাসিনা সরকারের অগণতান্ত্রিকতাকে বিরোধিতা করে ভারতের রোষের মুখে পড়েছে, যা চীনের প্রভাব বিস্তারে আরও এক বড় বাধা।
ওয়াশিংটন বাংলাদেশের হাসিনাবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল এবং তারা বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে, বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। ঢাকাও মার্কিন সাহায্য আশা করছে; কারণ তাদের ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড ও বিশ্ব ব্যাংকের থেকে বড় অঙ্কের ঋণ প্রয়োজন।
পত্রিকাটির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা, সমান্তরালভাবে ভারতও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে আছে; ঢাকার সঙ্গে বেজিংয়ের সম্পর্ক কতটা মজবুত হবে। আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কিছুটা বৈরিতার সম্পর্ক তৈরি হলেও, নয়াদিল্লি যদি ঢাকার সঙ্গে আগের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফিরে যায় তবে বাংলাদেশের ওপর কবজা তৈরি করতে বেইজিংকে বেশ বেগে পড়তে হতে পারে।
বাংলাদেশের এখনকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এবং ঢাকার জন্য ভারতের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, দুই দেশের পারস্পরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক পালাবদল সাধারণ চোখে দেখলে বেইজিংয়ের অবস্থান কিছুটা ভাল জায়গায় নিয়ে যাবে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু যারা ভাবছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চীন রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি জিতে গেল, তারা সর্বৈব ভুল! চীনের পুরোপুরিভাবে সফল হওয়া কখনই সম্ভব হবে না।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)