ট্রাইব্যুনালে কাঁদলেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, উত্তেজিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা
জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক পুলিশ প্রধান ও এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালকসহ আট জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শুনানিকালে ‘ভুল তথ্য’ শুনে কেঁদে ওঠেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম। আর দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে উত্তেজিত হতে দেখা গেছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে।
বুধবার (২০ নভেম্বর) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার শুনানি চলাকালে ও পরে এসব ঘটনা ঘটে।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামসহ অন্য প্রসিকিউটররা। অপরদিকে এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালক ও অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট নাজনীন নাহার।
শুনানির সময় চিফ প্রসিকিউটর সাভারের ঘটনায় ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি, ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুর ইসলাম এবং সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলামের নাম উল্লেখ করেন।
এসময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেন মাজহারুল ইসলাম। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি কখনও সাভারে দায়িত্ব পালন করিনি। আমি ছাত্রদের পক্ষে ছিলাম।’ তখন আদালত বলেন, ‘আমরা দেখবো। সম্পৃক্ততা না থাকলে ন্যায়বিচার পাবেন।’
চিফ প্রসিকিউটর পরে বলেন, ‘আমার ভুল হয়েছে। মাজহারুল ইসলাম সাভারে ছিলেন না। তিনি গুলশান থানার ওসি ছিলেন। এরপর তিনি গুলশান এলাকায় হত্যা ও নির্যাতনের বর্ণনা দেন।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মাজহারুল ইসলাম গুলশানে দায়িত্ব পালনের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে হত্যার নির্দেশ দেন।’ অবশ্য গুলশানের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়ার সময় নিশ্চুপ ছিলেন মাজহারুল ইসলাম।
শুনানির শেষদিকে বেশ কিছুক্ষণ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালকসহ জিয়াউল আহসান। ওই সময় তাকে বসাতে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেন তিনি। আদালত এজলাস ছাড়ার আগে জিয়াউল আহসানের আইনজীবী নাজনীন নাহার বিচারপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, জিয়াউল আহসান কথা বলতে চান। এসময় কাঠগড়া থেকে জিয়াউল আহসান বলেন, ‘আমি আয়নাঘরে কখনও চাকরি করিনি। আমি টেকনিক্যাল দায়িত্বে ছিলাম।’ এসময় আদালত বলেন, ‘তদন্ত চলছে। আপনার আইনজীবী আছে। আইনজীবী বলার পর প্রয়োজনে যোগ করবেন।’
এরপর শুনানি শেষে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক পুলিশ প্রধান ও এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালকসহ ৮ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
তারা হলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, বরখাস্ত ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, গুলশান থানার সাবেক ওসি মো. মাজহারুল হক, ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্লা ও ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম।
একইসঙ্গে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৯ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। একই দিন মামলার পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়।
এদিকে বিচারপতিরা এজলাস ছাড়ার পর দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আসামিদের কাঠগড়া থেকে হাজতখানায় নেওয়ার জন্য যান। এসময় জিয়াউল আহসান তাদের বলেন, ‘কেউ আমাকে ধরবে না, কাছে আসবে না। তোমরা মার খেয়েছো, ভবিষ্যতে আরও খাবে। আমাকে জেলখানায় কাগজ-কলম দেওয়া হয় না, আমি লিখবো। আমাকে কাগজ-কলম দিতে হবে। আমার বিরুদ্ধে যা বলেছে, তা আমাকে দাও। আমি দেখবো।’ এসময় তাকে বেশ উত্তেজিত দেখা যায়। তবে তার আইনজীবী নাজনীন নাহার আশ্বস্ত করে বলেন, ‘পরে সবই দেওয়া হবে।’
পরে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রিজনভ্যানে তোলার সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য জিয়ার দুই হাত ধরে রাখেন। এসময়ও তিনি তাদের হাত ছেড়ে দিতে বলেন। প্রিজনভ্যানে তোলার পর তিনি জানালা দিয়ে চিৎকার করে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, আমি আয়নাঘরে চাকরি করিনি। আর কোনও অভিযোগ দেবে না।
এর আগে গত ২৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুলিশের সাবেক ১৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল।
প্রসঙ্গত, গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কয়েকশ’ অভিযোগ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে জমা পড়েছে।
গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)