সাতক্ষীরার প্রাণসায়ের খালটি মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্র
তারিক ইসলাম, সাতক্ষীরা: সতক্ষীরার প্রাণ প্রাণসায়ের খালটি এখন মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। খালের অর্ধেকাংশ ময়লা আবর্জনা আর কচুরিপনায় ভরা। বাকি অংশের পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালের এই পচা পানিতে এডিস মশা জন্মানোর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী প্রাণসায়ের খাল। এ কারণে ডেঙ্গু ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে সাতক্ষীরা শহরের বাসিন্দারা।
সাতক্ষীরা শহরের বুক চিরে বহমান খালটির নাম প্রাণসায়ের। এই প্রাণসায়ের খাল ঘিরে গড়ে উঠেছিল একসময় সাতক্ষীরা শহর। কথিত রয়েছে ১৮৫০ সালের দিকে সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা ও শহরের শ্রীবৃদ্ধির জন্য খালটি খনন করেন। মরিচ্চাপ নদের সঙ্গে বেতনা নদীর সরাসরি যোগাযোগ রক্ষার জন্য সাতক্ষীরা শহরের ওপর দিয়ে ১৪ কিলোমিটার এ খাল খনন করা হয়।
খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এ খাল। এ খালের মাধ্যমে সহজ হয়ে উঠেছিল জেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও। জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরীর নাম অনুসারে খালটির নামকরণ করা হয় প্রাণসায়ের খাল। খননের শুরু থেকেই সাতক্ষীরা শহরের সৌন্দর্য বহনকরে আসছে ঐতিহ্যবাহী এই প্রাণসায়ের খাল।
কালের বির্বতনে প্রাণসায়ের খাল তার প্রাণ হারিয়ে ফেলেছে। সাতক্ষীরা শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের পরিবর্তে খালটি এখন পরিবেশ দূষনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে খালটি সাতক্ষীরা শহরের ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বদ্ধ খালটিতে ফেলা হচ্ছে শহরের ময়লা আবর্জনা। ফলে খনন কাজ শেষ হওয়ার দেড় বছর যেতে না যেতেই খালটি আবার ভরাট হয়ে গেছে। ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে পানি নিষ্কাশিত হতে না পারায় খালের কালো পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। খালের পাড়ের সড়ক দিয়ে লোকজনকে চলতে হয় নাক চেপে। ঐতিহ্যবাহী প্রাণসায়ের খালটি এখন পরিণত হয়েছে মশার নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্রে।
সরেজমিনে বুধবার (৯ আগষ্ট) সকালে শহরের সুলতানপুর বড়বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রাণসায়ের খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। বাজারের সব ময়লার পাশাপাশি পশু জবাই করার পর সমস্ত আর্বজনা ফেলা হচ্ছে খালের মধ্যে। শহরের পাকাপুল থেকে বড়বাজার ব্রীজ হয়ে কুখরালী পর্যন্ত খালটি ভরাট হয়ে গেছে। কচুরিপনায় ভরা খালের এই অংশের পাশে কয়েকটি স্থানে খালের মাঝ বরাবর বিভিন্ন আগাছা জন্মেছে। আর পাকাপুল থেকে গার্লস স্কুলের ব্রীজ হয়ে নারিকেলতলা পর্যন্ত খালের পানি পঁচে কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খাল পাড়ের সড়কে প্রাতভ্রমণে আসা নারী পরুষরা নাকে কাপড় দিয়ে হাটা চলা করছেন।
সকালে প্রাতভ্রমণে আসা শহরের পলাশপোল এলাকার সামছুর রহমান জানান, প্রতিদিন ভোরে খালপাড়ের এ সড়ক দিয়ে কয়েকশ’ মানুষ হাঁটাহাঁটি করেন। একইভাবে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সকালে ফজরের নামাজ আদায় করে খাল পাড়ের রাস্তায় হাটতে বের হই। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে খাল ধার দিয়ে হাটতে অসুবিধা হচ্ছে। খালের পানি পঁচে কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। প্রাণসায়ের খাল এখন মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এভাবে আরও কিছুদিন এই খাল ধারের রাস্তায় হাটলে অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে।
শহরের নাজমুল সরণিস্থ শ্রী জুয়েলার্সের সনাতন বসু জানান, প্রাণসায়ের খাল পাড়ে আমাদের স্বর্ণের দোকান। অনেক সময় কাজে খালের পাড়ে আসতে হয়। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে খালের পানি পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাতাস ছাড়লে দোকানের দরজা খুলে ভিতরে বসা যায় না। এছাড়া খালের পানি পঁচে কালো হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি মশার উপদ্রবও বেড়েছে। মশার কারণে সন্ধ্যার দিকে খালের পাড়ে যাওয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, খালের আশপাশের বাসিন্দারা ছাড়াও সুলাতপুর বড়বাজারে ব্যবসায়ীসহ অন্য ব্যবসায়ীরা ময়লা ও আবর্জনা ফেলে দুর্গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এতে সাতক্ষীরা শহরের পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরার সদর উপজেলার এল্লারচর থেকে খেজুরডাঙ্গী পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১০ কোটি ১৩ লাখ টাকা। খাল খননের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৯ সালের ১ আগস্ট। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ৩০ জুন। কিন্তু খনন কাজ শেষ হয় ২০২১ সালে জুনে। খননকাজ শেষ হওয়া খালটি দেড় বছর যেতে না যেতেই আবার ভরাট হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদার জানান, খালটি পাউবো খনন করলেও জমির মালিক পৌর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন। তাদেরই এটি রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা। যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় খালটির এ অবস্থা হয়েছে।
সাতক্ষীরা শহরের মুনজিত এলাকার সাবেক অধ্যক্ষ প্রবিত্রমহন দাস বলেন, খালটির মরিচ্চাপ নদের মুখে এলারচর ও বেতনা নদীর মুখে খেজুরডাঙ্গীতে নব্বই দশকে দুটি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এতে খালটি স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হতে থাকে। জলকপাট দুটি পরবর্তী সময়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খালের জোয়ার–ভাটা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালের জুনে খননকাজ শেষ হওয়া খালটি দেড় বছর যেতে না যেতেই আবার ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে বদ্ধ খালটিতে ফেলা হচ্ছে শহরের আবর্জনা। খালের পচা পানিতে আবর্জনা মিশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালপাড় দিয়ে লোকজনকে চলাচল করতে হয় মুখে রুমাল দিয়ে। খালের পানি পঁচে গিয়ে কালো ও দুর্গন্ধ হওয়ায় বর্তমানে মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাজকিন আহমদ চিশতী বলেন, মানুষ যাতে খালটিতে ময়লা–আবর্জনা না ফেলেন, সে জন্য বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু কেউ শুনছেন না। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির জানান, প্রাণসায়ের খালপাড়ের বাসিন্দা ও দোকানদারদের নোটিশ করে নিষেধ করা হবে। তাঁরা না শুনলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছেন না। খাল রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)