দীপশিখার আলোকবর্তিকা: কলাপাড়ার পাখীমারা প্রফুল্ল ভৌমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়
পটুয়াখালির কলাপাড়া উপজেলা সদর গড়ে উঠেছে আন্ধার মানিক নদীর উত্তর তীরে। কলাপাড়ার ঠিক দক্ষিণে আন্ধার মানিক নদী একটি দ্বীপ সৃষ্টি করে সাগরে গিয়ে মিশেছে, এই দ্বীপের মধ্য দিয়ে পটুয়াখালি-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়ক গিয়েছে। দ্বীপটির মাঝখানে পাখীমারা নামক স্থানে ছোট্ট একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নাম পাখীমারা প্রফুল্ল ভৌমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
৫০ তম ‘এডুকেশন রিসার্চ মেথডোলজি’ প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ফিল্ড ভিজিটে আমরা সাত জনের একটি দল গিয়েছিলাম উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানে। উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম-২০২১ বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করা, অবশ্য আমাদের গবেষণার বিষয় এটির ক্ষুদ্র একটি অংশ ছিল।
পাখীমারা প্রফুল্ল ভৌমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খেপুপাড়ার একটি স্বনামধন্য বিদ্যালয়। স্থাপিত ১৯৬৯ সাল, বর্তমান প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে আছেন বাবু সুকুমার চন্দ্র ভৌমিক। সকাল দশটা নাগাদ আমরা বিদ্যালয়ে হাজির হই। আমরা যে সেই প্রতিষ্ঠানে যাবো, এটি প্রতিষ্ঠান প্রধানকে জানানো হয়নি, মূলত শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়ন এর বাস্তব অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য হয়তো এই পদক্ষেপ! প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। আমাদের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে জেনে তিনি খুশি হলেন এবং ঐকান্তিক আগ্রহ প্রকাশ করলেন, প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরতে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণিতে পাঠদান শুরু হয়ে গিয়েছে, তিনি নিজে প্রতিষ্ঠানের সব কিছু আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন। আমরা যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির কক্ষে প্রবেশ করলাম দেখলাম ছোট্ট শিক্ষার্থীরা কয়েকভাগে ভাগ হয়ে গ্রুপে বিন্যাস্ত, তখন তাদের গণিত ক্লাস চলছিল। দলগতভাবে পড়াশোনার এই রূপ শহরের অনেক প্রতিষ্ঠানেই পরিলক্ষিত হয় না। বিভিন্ন শ্রেণিতে আমরা একই চিত্র পেয়েছি।
নবম শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাসে শিক্ষার্থীরা ডিএনএ-র প্রজেক্ট তৈরি করে এনেছে। অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে কিভাবে ইংরেজিতে ডায়ালগ করতে হয় তা শেখাচ্ছিলেন, অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজিতে যেভাবে কথপোকথন করল তা সত্যি বিস্ময়কর। শিক্ষক জানালেন কিছুদিন পূর্বে তারা একটি নাটক উপস্থাপন করে সাড়া ফেলেছেন অত্র এলাকায়, প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেইজে আমরা সেটি দেখেছি। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সৌর চুল্লি প্রজেক্ট তৈরি সহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উপর প্রজেক্ট তৈরি করেছে সেগুলো আমাদের দেখালো নিভৃত দ্বীপাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কিভাবে আলোকিত দেশ গঠনে নিজেদের তৈরি করছে? তা সত্যি আমাদেরকে পুলকিত করেছে!
শিক্ষার্থীরা জানালো আগের মুখস্থ নির্ভর শিক্ষার চেয়ে হাতে কলমে বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষনের এই শিক্ষা তাদের অনেক উপকারে লাগছে। তারা আনন্দঘন পরিবেশে নিজেদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে শ্রেণি কক্ষে ডিম ভাজা শেখানো নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় হয়, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে একজন মেয়ে শিক্ষার্থী বলেন, ‘রান্না করার কোনো নারী পুরুষ ভেদাভেদ নাই, এটি একটি দক্ষতা যে কেউ এটি শিখে রাখলে তার উপকারে আসবে। ধরেন কাজের সন্ধানে ছেলেরা বাইরে থাকে, বিদেশ থাকে, রান্না জানলে তার অনেক উপকার হয় আবার অর্থনৈতিক ভাবে সাশ্রয় হয়।’ শিক্ষার্থীর এই ভাবনা দেখে উচ্ছ্বসিত হলাম।
শিক্ষার্থীরা জানালো তারা একক কাজ, দলগত কাজ, স্কুলের বাইরে বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও বাস্তয়নের মাধ্যমে যে শিক্ষা অর্জন করছে তা আগের কারিকুলামের চেয়ে অনেক ভাল। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, বিজ্ঞানাগার, সততা স্টোর, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা সুপেয় পানির ব্যবস্থা সহ নানা উদ্যোগ চোখে পড়েছে।
এখানকার শিক্ষকদের আন্তরিক মনোভাব ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। তারা শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষা অর্জনে যে সহযোগী মনোভাব প্রদর্শন করেন, তা শিক্ষার্থীর আচার-আচরণ, জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা দেখেই বোঝা যায়। শিক্ষকগণ নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক আশাবাদী, তারা প্রত্যাশা করেন এটির সঠিক বাস্তবায়ন দেশকে অনেক এগিয়ে নেবে। তবে অল্প বয়সী শিক্ষার্থীর উপর কিছু পাঠ্যবইয়ের কন্টেন্ট কিছুটা চাপ তৈরি করেছে এটাও জানালেন। তাছাড়া অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে দেশ গঠনে আগামী প্রজন্ম গড়ার কাজ করলেও শিক্ষা ব্যবস্থার আর্থিক দিক নিয়ে তারা চিন্তিত। তারা তাদের পরিশ্রমের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে আরেকটু প্রণোদনা প্রত্যাশা করেন, যেন আর্থিক চিন্তা তার জ্ঞান বিতরণের দ্বারকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক পরম মমতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর শিখন পরিবেশকে রক্ষা করে চলেছেন। একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি আন্তরিক হন তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গোটা দল একটি প্রতিষ্ঠানকে অনন্য করে তুলতে পারে, এটিই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
শিক্ষক স্বল্পতা, অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতাসহ স্বল্প আর্থিক সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের বহু জায়গায় এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্ঞানের দীপশিখা জালিয়ে চলেছে। ২০৪১ সালের স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠন ও স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে এই ধরণের প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ অবদান রেখে যাচ্ছে। সময়ের সঠিক পদক্ষেপে এই সকল প্রতিষ্ঠান এক একটি আলোকবর্তিকা রূপে প্রতিভাত হবে।
মো. আশরাফুজ্জামান
৫০ তম ই.আর.এম প্রশিক্ষণার্থী, নায়েম।
প্রভাষক, যশোর সরকারি মহিলা কলেজ,
যশোর।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)