প্রসঙ্গ; চাঁদের জমির মালিকানা
প্রসঙ্গ; চাঁদের জমির মালিকানা
নাজমুল হক
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, মঙ্গলগ্রহ ও চাঁদে জমি ক্রয় করা জমির কাগজপত্র, পর্চা এবং জমির নিশানা সংবলিত দলিল ক্রেতারা পেয়েছেন। মাত্র ৫৫ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে চাঁদে ১ একর জমি কিনেছেন। আর মঙ্গলগ্রহে ৪৫ ডলার দিয়ে। ‘লুনার অ্যাম্বাসি (চান্দ্র দূতাবাস)’ এর মালিক ডেনিস হোপের কাছ থেকে এই জমি ক্রয় করেন তারা। কিছুদিন আগে জমি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে সাতক্ষীরার দুই বন্ধু সেখানে চিঠি লিখেছিলেন এবং ডলার জমা দিয়েছিলেন। এর জবাবে চাঁদের গ্রামীণ এলাকার ১ একরের একখন্ড জমির মালিকানা সংবলিত কাগজপত্র তারা হাতে পেয়েছেন। একইসঙ্গে পেয়েছেন জমির অন্যান্য কাগজপত্রও।
জমি বিক্রয় করতে গেলে জমির বৈধ মালিকানা থাকতে হবে। দেশের আইনে আছে বিক্রেতা রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে, এর সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমির দলিল, পর্চা, খাজনা দাখিলা দিতে হয়। আবার ক্রেতার টিন সার্টিফিকেট থাকতে হয়। সরকারের নির্দিষ্ট খাতে রাজস্ব ফি জমা দিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমনটি করা হয়েছে কি? কেউ একজন চাঁদের মালিকানা দাবি করলো আর আমরা হুমড়ি খেয়ে অন লাইনে কেনার দাবী করলাম কতটুকু যুক্তিযুক্ত? আবার বলা হচ্ছে গ্রামীন এলাকায় জমি কেনার কথা, কিন্তু চাঁদে কি গ্রাম বা শহর আছে?
বর্তমান সময় মিডিয়া ছাড়া অচল। একটি খবর মুহুর্তের মিডিয়ার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জনমনে ব্যপকভাবে প্রভাব পড়ে। যদি আমি দাবী করি হোয়াইট হাউজ ক্রয় করেছি বা হোয়াইট হাউজের কিছু অংশ ক্রয় করেছি। এর স্বপক্ষে অনলাইনের কিছু কাগজও হাজির করলাম। তাহলে মিডিয়া কি প্রচার করতে হোয়াইট হাউজ বিক্রি হয়ে গেছে? নাকি আরো যাচাই-বাছাই করে সংবাদ প্রকাশ করবে। আমার সাধারণ জ্ঞানে বলে, যখন কোন বিষয় সংবাদের উপদান হিসেবে আসে তখন যেটি যাচাই বাছাই করা হয়। যাচাই-বাছাই করে সংবাদ উপযোগী ও সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পরেই সেটি প্রকাশ যোগ্য হয়। কিন্তু চাঁদে জমি কেনার ক্ষেত্রে কি সেটা হয়েছে? নাকি কেউ দাবী করলো আর আমরা প্রচার করলাম তাহলে সাংবাদিকদের দায়-দায়িত্ব কতটুকু? সাধারণ কথাও কি বলে, অজ-পাড়াগায়ে বাস করে কোন গ্রহ বা উপগ্রহে কোন জমি কেনা সম্ভাব তাও মাত্র ৫ হাজার টাকায়? ৫ হাজার টাকায় এক একর জমি বিশ্বের কোথাও কি আছে? গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী দুই ব্যক্তি ৫ হাজার টাকায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাতারে গেলেন ৫ হাজার টাকায়, যা হাস্যকর ছাড়া কিছুই না।
আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। চাঁদ নিয়ে কতো কবিতা, গান, গল্প আছে। আছে কল্পনার এক বিস্তার নিবেদন। প্রথমে মঙ্গলগ্রহে জমি কেনার দাবী করেছেন লালমনিরহাটের এক প্রকৌশলী আর চাঁদে জমি কেনার দাবী করেছেন সাতক্ষীরার দুই শিক্ষার্থী। মঙ্গলগ্রহে জমি কেনার সংবাদের পরে এবার গণমাধ্যমে সংবাদ বেরিয়েছে চাঁদে জমি কেনা নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে চাঁদে জমির মালিকানা কোন দেশের এবং কোন ব্যক্তির? চাঁদের জমি বিক্রি করতে কোথায় রেজিস্ট্রি করতে হবে? কোথা থেকে দলিল-পর্চা পাওয়া যাবে? সরকার কি মঙ্গলগ্রহ বা চাঁদে জমি কেনার অনুমতি দিয়েছেন কোন বাংলাদেশীকে? বাংলাদেশে থেকে মূল্য কিভাবে পরিশোধ করেছেন? গ্রহ বা উপগ্রহে কি কোন কিছু কেনা সম্ভব? গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশ কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
এবার আসি চাঁদের মালিকানা নিয়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে জনৈক ব্যক্তি হোপের নিকট থেকে চাঁদের জমি কিনেছেন? হোপ কি চাঁদের আসলেই মালিক? চাঁদ একটি উপগ্রহ। অর্থাৎ চাঁদের জমি বিক্রি করতে গেলে তাকে চাঁদের জমির মালিক হতে হবে। কিন্তু একটি উপগ্রহের মালিক হোপ কিভাবে হলেন? আবার তার কাছ থেকে আমরা কিভাবে ক্রয় করলাম? তিন যুবক নিজেদের কাটতি বা আলোচনায় রাখতে এমন তথ্য সাংবাদিকদের দিলেন?
যা হোক একটু তথ্য দিয়ে রাখি, ১৯৬৭ সালের ২৭ জানুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। ‘দ্য আউটার স্পেস ট্রিটি’ নামক এই চুক্তি আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। চুক্তিতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে, চাঁদ এবং অন্যান্য যেসব বস্তু রয়েছে সেগুলো কোনো দেশ দখল বা নিজেদের একক সম্পত্তি দাবি করতে পারবে না। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১১০টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। আরো ২৩টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও করোনাজনিত কারণে সভা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় তাদের স্বাক্ষর অনুমোদনের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ১৯৭৯ সালে চাঁদ এবং মহাশূন্যের অন্যান্য বস্তুতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কর্মকান্ড পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সমঝোতা প্রস্তাব আনে জাতিসংঘ; যেটি ‘মুন এগ্রিমেন্ট’ নামে পরিচিত। সেখানে মূল বিষয়গুলো ছিল, এসব কর্মকান্ড হতে হবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে এবং কোনো মহাকাশ স্টেশন বানাতে হলে আগে জাতিসংঘকে জানাতে হবে।
আমেরিকান আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি মালিকবিহীন সম্পদের মালিকানা দাবি করে, অন্য কোনো ব্যক্তি সেই সম্পদে দাবি না রাখে এবং দলিলে যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা স্বাক্ষর করে তাহলে সেই ব্যক্তি উক্ত সম্পদের মালিক হবে। ১৯৮০ সালে হোপ নামের এক ব্যক্তি চাঁদের মালিকানার ডকুমেন্ট তৈরি করে কৌশলে তা স্বাক্ষর করিয়ে নেন এবং নিয়ম অনুযায়ী চাঁদের মালিক হিসেবে জমি বিক্রি শুরু করেন। হোপের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘লুনার এম্বেসি কমিশন।’ এছাড়া ‘দ্য লুনার রেজিস্ট্রি’, ‘লুনার ল্যান্ড’সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানে চাঁদে জমি বিক্রির অফার দিচ্ছে। কিন্তু সেটা কতটা বৈধ? চাঁদের আলো তো পৃথিবীতে আসে। সম্বব হলে মালিক চাঁদের আলো বন্ধ করে দিক বা চাঁদ উঠা বন্ধ করুক। যেহেতু চাঁদের মালিক হোপ তাই তিনি ইচ্ছা করলেই তো চাঁদে যেতে পারেন, কিন্তু গিয়েছেন কি কখনও। আমাদের দেশের ব্যক্তিগণ তো গ্রহ বা উপগ্রহের মালিক তারা তো ইচ্ছা করলে চাঁদের ঐ অংশ বন্ধ করে দিতে পারেন, তাকি সম্ভব?
বস্তুত; গ্রহ বা উপগ্রহের মালিকানা কোন দেশ বা ব্যক্তির নয়। এক শ্রেণির মানুষ প্রতারণা করে বিক্রির অফার দিচ্ছে। আর যারা সস্তা জনপ্রিয়তার আশা করেন তারাই এটা কেনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। যেমনটি ব্যক্তি বিশেষের পদক ক্রয়ের মতো। তাই এই সব ব্যক্তি থেকে সাবধান হতে হবে। তারা নিজেদের স্বার্থে যে কোন কিছু রটাতে পারে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমে কর্মরতদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।
লেখক:
নাজমুল হক,
গ্রাম- উত্তর কাটিয়া, ডাক- থানা ও জেলা- সাতক্ষীরা
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)