বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
বাংলাদেশের আইনে কোনটা ধর্ষণ, কোনটা নয়?
বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নবিরোধী কঠোর আইন থাকলেও এ নিয়ে বিভ্রান্তিও কম নেই।
বিবাহিত স্ত্রীর অনিচ্ছাসত্বেও তার সাথে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করলেও কি সেটা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে? প্রেমিক-প্রেমিকা যদি বিয়ের আগেই পরস্পরের সম্মতিতে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করে সেটা কী? সেই প্রেমিকা যদি হন অপ্রাপ্তবয়স্ক? বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ-ই বা কাকে বলা হচ্ছে?
আসুন জেনে নেওয়া যাক এগুলোর পেছনের আইনি ব্যাখ্যা-
১৬ বছরের কম বয়সীর সম্মতি গ্রহণযোগ্য নয়
বাংলাদেশের নারী ও শিশু দমন নির্যাতন আইনে শিশুকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ১৬ বা তার কম বছর বয়সী ছেলে ও মেয়ে উভয়কে।
মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্টের গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবির হুদার মতে, এই সংজ্ঞায় শিশুকে ভুক্তভোগী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই বয়সে মৌখিক বা লিখিত কোনও সম্মতি দেওয়ার মতো ক্ষমতা শিশুর গড়ে ওঠে না।
তাই এই বয়সী কেউ যদি যৌন সম্পর্কে সম্মতি দিয়েও থাকে সেটা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
ফলে যদি কোনও পুরুষ ১৬ বছরের কম বয়সের কোনও নারীর সাথে তার সম্মতি নিয়েও শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করেন, সেটাও ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুযায়ী। আর সম্মতি ছাড়া হলে তো কথাই নেই। সেটা বয়স নির্বিশেষে ধর্ষণ।
আবার আইন অনুযায়ী কোনও অবিবাহিত নারী আদালতে এমন অভিযোগও আনতে পারেন তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে, যেটা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করবে বাংলাদেশের আদালত।
এমনকি সেখানে অভিযোগকারীর বয়স ষোলোর বেশি হলেও আইনের দৃষ্টিতে ছাড় নেই।
একই আইনে ভয় দেখিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে কিংবা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাও ধর্ষণ।
আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে দায়ী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
কিন্তু শিশু আইনে শিশুর সংজ্ঞায় বয়সের সীমা রাখা হয়েছে ১৮ বছর বা তার কম।
সেক্ষেত্রে অপরাধীর ক্ষেত্রে এই বয়স প্রাধান্য পাচ্ছে। ভুক্তভোগীর বয়স এখানে মুখ্য নয় বলে জানিয়েছেন তাকবির হুদা।
তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তির বয়স যদি ১৮ বা তার কম থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হলেও সেটার বিচার হবে শিশু আইনে।
অন্যদিকে, নারী ও শিশু দমন নির্যাতন আইনে মামলা সত্ত্বেও ভুক্তভোগী যদি বেঁচে থাকেন এবং তার বয়স যদি ১৮ বছরের নীচে থাকে তাহলে তার শিশু আইনের আওতায় শিশু আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসার সুযোগ আছে।
তবে বিচার হবে নারী ও শিশু দমন নির্যাতন আইন অনুসারেই।
বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ
বাংলাদেশে অনেক মামলাই হয়, যেখানে অভিযোগ করা হয়, ভুক্তভোগীকে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে’ ধর্ষণ করা হয়েছে।
নারী ও শিশু দমন নির্যাতন আইনে যেহেতু বলা আছে, যদি প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করে যৌন সম্পর্ক করা হয়, তাহলে সেটা ধর্ষণ হিসেবে দেখা হবে।
এখন বিয়ের প্রলোভন দেখানোর বিষয়টি আইনানুযায়ী প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায়ের মধ্যে পড়লেও আদালতে অনেক সময় সেটা নাও টিকতে পারে।
এটা নির্ভর করে কতদিন ধরে বিয়ের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, সম্পর্কের গভীরতা কেমন ছিল, লিখিতভাবে বিবাহিত না থাকলেও ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে করেছিলেন কিনা, কোনও সাক্ষী আছেন কিনা সেগুলোর ওপরেও নির্ভর করে বলে জানান তাকবির হুদা।
কিন্তু একই রকম অভিযোগ কোনও পুরুষ আনতে পারবেন না, বাংলাদেশের আইনে সেই সুযোগ নেই।
বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণ বা ম্যারিটাল রেপ
বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে জোরপূর্বক শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করাকেও পৃথিবীর কোনও কোনও দেশে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এটা শাস্তিযোগ্য। এই ধরণের যৌন সহিংসতাকে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণ বা ম্যারিটাল রেপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
জাতিসংঘও এটিকে ভয়াবহ ধরণের পারিবারিক সহিংসতা বলে মনে করে।
কিন্তু বাংলাদেশের আইনে এমন অপরাধের উল্লেখ নেই।
অর্থাৎ বিবাহিত স্ত্রীর সাথে তার অনিচ্ছায় বা জোরপূর্ব শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করলেও সেটা যৌন সহিংসতা বা যৌন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।
তবে বিবাহিত স্ত্রীর বয়স যদি ১৩ বছরের কম হয় এবং তার স্বামী যদি জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক করেন তাহলে ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারেন।
সেক্ষেত্রে শাস্তি শুধুমাত্র অর্থদণ্ড বা সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্লাস্টের গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবির হুদা।
স্ত্রীর বয়স যদি ১৩ বছর বা তার বেশি হয় তাহলে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের ফৌজদারি মামলা দায়েরের কোনও সুযোগ নেই।
সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পারিবারিক সহিংসতা আইনের অধীনে যৌন সহিংসতার মামলা করলে কিছু প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।
শুধু দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার পাওয়া যাবে অর্থাৎ আদালত স্বামীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ, ভরণপোষণের আদেশ দিতে পারে।
তবে অভিযুক্ত স্বামী এসব আদেশ লঙ্ঘন করলে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন
২০২০ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যোগ করা হয়।
এর ফলে বাংলাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারায় এতদিন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর যদি মৃত্যু হয় বা গণধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হয় বা আহত হন, তাহলেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল।
সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লাখ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধান ছিল।
সেই আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে।
এর ফলে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া সপ্তম দেশ হল বাংলাদেশ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলেও একই শাস্তি হবে।
যদি কোনও ব্যক্তি তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শ্লীলতাহানি করেন তাহলে এটি যৌন নিপীড়ন বলে বিবেচিত হবে।
এজন্য ওই ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর এবং ন্যূনতম তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা হবে।
এছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে যদি কোনও নারী ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন ওই ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, তিনি বা তারা প্রত্যেকে হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, সর্বোচ্চ ১০ বছর কিন্তু ন্যূনতম পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)