দালাই লামার সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠক, কড়া হুঁশিয়ারি চীনের
তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামার সঙ্গে দেখা করতে ভারতের হিমাচল প্রদেশের ধরমশালায় এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল।
চীন এনিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তিব্বতকে চীনের অংশ হিসেবে বিবেচনা না করে তাহলে তারা এ ব্যাপারে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেবে।
মার্কিন সাত সদস্যের এই প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা দলাই লামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এই সফর এমন একটা সময়ে হচ্ছে, যখন চীন-তিব্বত বিরোধ নিয়ে সম্প্রতি পাস হওয়া একটি বিল নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
দালাই লামার সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি দলের নির্ধারিত বৈঠক নিয়ে চীন কিছুটা সতর্ক করার ভঙ্গিতে বলেছে যে আমেরিকা যদি তিব্বতকে চীনের অংশ হিসাবে বিবেচনা না করে তার আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে, তবে চীন এ ব্যাপারে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেবে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, এটা সবাই জানে যে চতুর্দশ দালাই লামা পুরোপুরি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নন, বরং ধর্মের নামে চীন-বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত একজন নির্বাসিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
চীন-তিব্বত বিরোধ সমাধানের স্বপক্ষে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া আইনটিকে যাতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সমর্থন না করেন, সেই আহ্বানও জানিয়েছেন লিন।
তিনি বলেন, এই বিলে স্বাক্ষর করে এটিকে আইনে পরিণত করা যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে না। চীন তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।
এদিকে ভারতে অবস্থিত চীনা দূতাবাসের তরফে একটি দীর্ঘ বিবৃতি জারি করে বলা হয়েছে, আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই যে দালাই লামা গোষ্ঠীর চীন-বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী অবস্থানকে ভালো মতো বুঝুন, শিজাং (তিব্বতকে চীন যে নামে অভিহিত করে) সম্পর্কিত বিষয়ে চীনকে দেওয়া মার্কিন প্রতিশ্রুতিগুলিকে সম্মান করুন এবং বিশ্বকে ভুল সংকেত পাঠানো বন্ধ করুন।
অন্যদিকে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, শিজাং বরাবরই চীনের অংশ ছিল। শিজাং পুরোপুরি চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাইরের কোনো হস্তক্ষেপের অনুমতি কখনোই দেওয়া হবে না। চীনকে নিয়ন্ত্রণ আর দমন করার লক্ষ্য নিয়ে শিজাংকে অস্থির করে তোলার প্রচেষ্টা করা কোনও ব্যক্তি বা কোনও শক্তিরই উচিত নয়। এধরনের প্রচেষ্টা কখনই সফল হবে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানাচ্ছি যে শিজাংকে চীনের অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যেন মেনে চলা হয় এবং ‘শিজাংয়ের স্বাধীনতা’-র ভাবনাকে সমর্থন না করা হয়। চীন তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থ রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
দালাই লামার সঙ্গে দেখা করতে আসা মার্কিন প্রতিনিধিদল একটি বিশেষ বিল নিয়ে আলোচনা করবেন, যে বিলে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন খুব শিগগিরই সই করতে চলেছেন।
ওই বিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে তিব্বতের সঙ্গে যাতে তারা চলমান সব বিবাদ মিটিয়ে নেয়, তার জন্য চীনের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা।
ভারতে নির্বাসনে থাকা তিব্বতের পার্লামেন্টে মঙ্গলবার ভাষণ দেন ন্যান্সি পেলোসি। পার্লামেন্টের ভেতরে পেলোসির ভিডিও বেশ কয়েকটি নিউজ চ্যানেলে চালানো হলেও তিনি তার ভাষণে কী বলেছেন তা প্রকাশ করা হয়নি।
মার্কিন হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস সম্প্রতি ‘তিব্বত-চীন বিরোধ নিষ্পত্তিকে উৎসাহ প্রদান’ আইন ৩৯১-২৬ ভোটে পাশ করেছে।
ইতিমধ্যেই মার্কিন সিনেটে তা পাশ হয়ে গেছে।
ওই বিল অনুযায়ী, তিব্বতের ইতিহাস, মানুষ ও প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে সম্পর্কে চীনের ‘মিথ্যা তথ্য’-এর মোকাবিলা করতে অর্থ সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
তিব্বত তাদের অংশ বলে চীন যে দাবি করে, সেই ভাষ্যের পাল্টা জবাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই বিলে।
তিব্বতের নেতাদের সঙ্গে চীনের যে আলোচনা ২০১০ সাল থেকে বন্ধ হয়ে আছে, তা আবারও চালু করার জন্য চীনের ওপরে চাপ সৃষ্টি করার কথাও বলা হয়েছে এই বিলে, যাতে তিব্বত নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো যায়।
এছাড়াও ওই বিলে এটাও বলা হয়েছে যে, চীনের উচিত তিব্বতি জনগণের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত পরিচয় নিয়ে যে উদ্বেগ আছে, তার দিকে নজর দেওয়া।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল চীনের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে দালাই লামা ধর্মীয় নেতা নন, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
তার কথায়, দালাই লামা একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। তিব্বতের সভ্যতার পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা, তিব্বতের জনবিন্যাস বদলে দেওয়া, সামরিক দখলদারিত্ব, তিব্বতের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করা সত্ত্বেও তারা কখনও হিংসার আশ্রয় নেয়নি। তারা চীনের সঙ্গে যেতে রাজি আছে, যদি তিব্বতের স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয় চীন । চীন আজ নিজেকে শান্তিকামী বলে দাবি করে। তাহলে কেন দলাই লামার সঙ্গে শান্তি স্থাপন করা হচ্ছে না?
তার মতে, এর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গেও চীনের শান্তি স্থাপিত হতে পারে।
চীন ও তিব্বতের মধ্যে বিরোধ কয়েক শতকের।
চীন বলে থাকে যে ১৩ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই তিব্বত তাদের দেশেরই অংশ ছিল। অন্যদিকে তিব্বতিদের দাবি, তারা বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল এবং তাদের ওই অঞ্চলের ওপরে চীনের অবিচ্ছিন্ন কর্তৃত্ব ছিল না।
মঙ্গোল রাজা কুবলাই খান ইউয়ান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং শুধু তিব্বত নয়, চীন, ভিয়েতনাম এবং কোরিয়াতেও তিনি তাঁর রাজত্ব প্রসারিত করেছিলেন।
এরপর সপ্তদশ শতাব্দীতে চীনের চিং রাজবংশ তিব্বতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রায় ২৫০ বছরের সুসম্পর্কের পর চিং বাহিনী তিব্বতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই তিব্বতিরা চিং বাহিনীকে তাড়িয়ে দেয়। অবশেষে ১৯১২ সালে ত্রয়োদশ দালাই লামা তিব্বতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এরপর ১৯৫১ সালে চীনা সেনাবাহিনী আবার তিব্বতের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তিব্বতের সার্বভৌমত্ব চীনের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে, এমন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয় এক তিব্বতি ‘প্রতিনিধি সমিতির’ কাছ থেকে। দালাই লামা ১৯৫৯ সালে ভারতে চলে আসেন এবং তখন থেকেই তিনি তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করে আসছেন।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)