নড়াইলের জমিদার মানেই ইতিহাসের কথা বলে
নড়াইলের জমিদার মানেই আমাদের অস্তিত্ব
ইতিহাসের কথা চলে আসে। নড়াইলের জমিদারদের কথা জানতে গেলে সমগ্র পূর্ব বাংলার কথাই চলে আসে. আবার পূর্ব বাংলার কথা জানতে গেলে সারা পৃথিবীর কথা চলে আসে. তার কারণ নানা জাতি বর্ণ ও গোত্রে যাহাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো. আমি ভালবাসি।তাদের যাইহোক মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে, ইতিহাস মানুষ সৃষ্টি করে না. আর আজকের কাজ আগামীকালের ইতিহাস যা মানুষ মনে প্রাণে ধারণ করে পথ চলে. ইতিহাস দেখে লেখা যেমন সহজ, পড়ে লেখা অনেক কঠিন. তারপরও মানুষ সময়ের সাথে সাথে তাকে মনে প্রাণে ধারণ করে বলেই আমরা পৃথিবীর ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে পারি পৃথিবীতে মানুষকে মেধা মনন জ্ঞান দিয়ে সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন. আর মানুষের প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশ ছিল .পড়. জান ও কলম দ্বারা লিখ. কিন্ত আমরা আজ এমন একটা যুগে বাস করছি যখন আমরা মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে পড়ছি, লিখছি যা অতীতে আমরা কল্পনাও করতে পারি নাই. আর এটাই হল সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মেধা বিকাশের বহিঃপ্রকাশ।পৃথিবী সৃষ্টির পর হতে অনেক সময়, অনেক ইতিহাস সৃষ্টি করেই আজ এখানে উপনিত হয়েছে. বিজ্ঞানের মত ইতিহাসও তত্ত্ব নির্ভর পৃথিবীতে মানুষের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট ছকে বেধে দিয়েছেন যাকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়. যার কারণে পৃথিবীতে মানুষ থাকে না, কেবল থাকে মানুষের চিন্তা চেতনা ও কার্যাবলী. আর মানুষের সেই কার্যাবলীই চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়. আজ নড়াইল একটি জেলা. আর নড়াইল মানেই জমিদারদের ইতিহাস. আর নড়াইলের ইতিহাস মানেই আমাদের অস্তিত্ব. আর তখনই আমরা গর্ব অনুভব করব, যখন আমরা আমাদের সত্যিকার ইতিহাসকে জানতে পারব. আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা পূর্ব বাংলার একটি উন্নত সমৃদ্ধি শালী প্রাচীন জনপদে জন্মগ্রহণ করেছি. আর দুর্ভাগ্য হল আমরা সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্মস্থান ও পূর্বসুরীদের ইতিহাস জানতে ও বুঝতে পারিনি.
ঐতিহাসিক ভুতাত্ত্বিকদের মতে নড়াইল জেলা গংগানদীর পলি মাটি থেকে সৃষ্ট বংগেয় বদ্বীপসমুহের এক ভূখনড. আর এ থেকেই বোঝা যায় সমগ্র পূর্ব ভূখনডই ছিল পলিমাটি দ্বারা গঠিত একটি উর্বর নিম্ন ভূমি যেখানে প্রচুর ফসল উৎপাদন হত আর বাস করত নিম্নবিত্ত পরিবার যাদের পেশা ছিল কৃষি. যার কারণে গুপ্ত, পাল, সেন বংশীয় রাজারা রাজত্ব করত. তারপর মুসলিম মোগল শাসন.
বাংলা বিহার ও উড়িষরের সম্ভবতঃ এই অঞ্চলই বেশি নিচু যার কারণে শিক্ষা জ্ঞানেও ছিল নীচু. ইষট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বাণিজ্য করার সুযোগ পেয়েছিল. পূর্ব বাংলায় তারা বাণিজ্য করে নিজেদের সভভতার বিকাশ ঘটিয়ে ছিল কিন্তু পূর্ব বাংলার কথা ভাবেনি. ঠিক তেমনি একটি সময় নবাব আলী বরদী খা যার রাজত্বকাল ১৭৪০ হতে ১৭৫৬. যিনি মুসলিম শাসক হয়েও উদারপনহী চিন্তা চেতনা ও শিক্ষা বিস্তার প্রসারের জন্য শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের তার অধীনে নিয়োগ দেন. কিন্ত মারাঠা বর্গী ও আফগান পাঠানদের বিদ্রোহ ও অত্যাচার বেড়ে যাওয়ায় তারা প্রাণের ভয়ে অনেকেই পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করেন. আর তাদেরই একজন কর্মচারী মদনগোপাল দত্ত যিনি সম্ভবতঃ ১৭০০ সনের মাঝামাঝি সময়ে পরিবার নিয়ে নৌকা যোগে নড়াইল আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন. যেহেতু তিনি ছিলেন শিক্ষিত তাই তিনি তার সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলেন.
নড়াইল অঞ্চলে সেদিন খাল বিল কাদামাটি ছাড়া কিছুই ছিল না, সবই ছিল উচু এলাকা ভারত পাকিস্তান অংশে. নড়াইলের ইতিহাসে দেখা যায় মদনগোপাল দত্তের পৌত্র রুপরাম দত্ত একজন সরকারী আইনজীবী যিনি নাটোরের রানী ভবানীর রাজবাড়িতে চাকুরী করতেন. নিশ্চয়ই রুপরাম দত্ত লেখাপড়া করেছিলেন কলকাতা. প্রাচীন কালে বিবাহ হত সমগোত্রে তথা ধন সম্পদ মান সম্মান প্রতিপত্তি দেখে. রুপরাম দত্ত প্রসিদ্ধ গুয়াতলীর মিত্র বংশীয় কৃষ্ণরাম মৃততের দ্বিতীয় কন্যাকে বিবাহ করেন. তাদের তিনটি সন্তান. যথা.. ননদ কুমার, কালিশংকর রায় ও রামনিধি. রুপরাম দত্ত খুব কম বয়স থেকে নাটোরের রানী ভবানীর রাজবাড়িতে চাকুরী করতেন. ধীরে ধীরে এক সময় রানীর বিশ্বস্ততা অর্জন করে মুর্শিদাবাদ রাজ দরবারে সরকারি আইনজীবী হিসেবে পৌঁছে গেলেন. আর সেখান থেকে তিনি প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হন এবং নড়াইলের আলাদতপুরের তালুক ক্রয় করেন. তিন পুত্রের ভিতর কালিশংকর রায় ছিলেন স্মার্ট ও চালাক চতুর অর্থাৎ জ্ঞানী. জন্মের পর পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষের মেধা বিকাশে সাহায্য করে. সেই শতাব্দীতে একজন আইনজীবীর সন্তান হিসেবে এবং কম বয়সে জমিদারদের কার্যাবলী দেখে হয়ত তার ভিতর জমিদার হবার বাসনা সৃষ্টি হয়েছিল যার কারণে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে নায় অন্যায়বোধ তার ভিতর কাজ করেনি. টার্গেটে পৌঁছানোই ছিল তার লক্ষ্য. ব্রিটিশ ভারতীয় গভর্নর জেনারেল লর্ড চার্লস কর্ণওয়ালিস কর্তৃক ১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারের খাজনা বকেয়া পড়ে. যার কারণে জমিদারী তালুক পর্যায়ক্রমে বিক্রি হতে থাকে. এই সময়ে কালিশংকর রায় ও অন্যান্য কর্মচারীরা তা নামে বেনামে ক্রয় করে. যার কারণে কালি শংকর রায় অগাধ ধন সম্পদের মালিক হন.জমিদার কালিশংকর রায় ১৭৯১ সনে পিতা রুপরামের তৈরিকৃত ছোট বাড়িটিকে প্রসারিত করে সুরমম অটটালিকা, মন্দির, মনডপ, কাচারী, নাট্য মঞ্চ, অনেক দীঘি পুকুর সহ ফলফুলের বাগান করেন. বাড়ির কাছে রুপগনজ বাজার তৈরি করেন. চিত্রা নদীর ঘাটে বিরাট বাধাঘাট তৈরি করেন. সোজা কথায় একটি মোগল আমলের জমিদারদের মত করে সবকিছুই তৈরি করেন যার নাম নুতন সভভতা. অর্থাৎ নড়াইলকে নুতন সভভতায় গড়ে তোলেন. আর এই কালিশংকর রায় হলেন নড়াইলের প্রথম জমিদার. তিনি দুটি জমিদার বাড়ি তৈরি করেন. একটি নড়াইল এবং আরেকটি কিছু দুরে হাটবাডিয়া জমিদার বাড়ি.পৃথিবীতে দোষগুন নিয়েই মানুষ. ইতিহাসে দেখা যায় তিনি একজন সাম্প্রদায়িক অত্যাচারী জমিদার. তিনি নিম্ন বংশের হিন্দুদের দিয়ে একটি লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেছিলেন. এলাকায় কোন গরু জবাই হলে তাদের ধরে এনে অত্যাচার করা হত. বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতি ও জুতা পায়ে লোক চলতে দেয়া হতনা. যা ছিল বাংলার সামগ্রিক জমিদারদের বৈশিষ্ট্য.ইতিহাসে আছে ব্যবসা বানিজ্য কারণ ঘটিত একবার তার লাঠিয়াল বাহিনী নৌকা ভর্তি মালামাল লুঠ করেছিলেন. তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল. ১৭৮৪ সনে যশোহর এর প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট হেংকেল সাহেব তাকে ডাকাত বলে অভিহিত করেছিলেন. তিনি কুতুবুললাহ সর্দারের অধীনে কিছু সেপাইকে তাকে ধরার জন্য পাঠালে তার ১৫০০ লাঠিয়াল বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়. যুদ্ধে কুতুবুললাহ সর্দারের ২ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়. তারপর বেশি সংখ্যক সেপাই পাঠালে তিনি কলকাতা পালিয়ে যান ও ননদ কুমার ধরা পড়েন. এই হল নড়াইলের জমিদার কালিশংকর রায়ের অত্যাচারের ইতিহাস. কালিশংকর রায়ের দুই পুত্র. তারা হলেন.. রামনারায়ন ও জয় নারায়ণ। নড়াইলের জমিদার কালিশংকর রায় তার দুই সন্তানকে দুটি বাড়ি ও জমিদারী বুঝিয়ে দিয়ে ৭০ বছর বয়সে ধর্মীয় চেতনা নিয়ে গয়া কাশী গমন করেন. সেখানেও একটি ইতিহাস রয়েছে যা হল তখন সেখানে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল. তিনি শুকৌশলে তার সমাধান করে সেখানে শান্তি ও মানবতা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন. যার কারণে আজও তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। জমিদার কালিশংকর রায় গয়া কাশিতে দীর্ঘ ১৫ বছর পর জগতের শান্তির জন্য কাজ করে ১৯৩৪ সনে ৮৫ বছর বয়সে কাশিতে মৃত্যুবরণ করেন অর্থাৎ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে পূর্বের কৃতকর্মের জন্য তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে গেছেন. অন্যদিকে, তার দুই পুত্র তার মৃত্যুর আগে ১৯১৭ ও ১৯২২ সনে মৃত্যুবরণ করেন। জমিদার রাম নারায়ণের তিন পুত্র. যথা. রামরতন, হরনাথ ও রাধাচরণ. আর জয় নারায়ণের দুই পুত্র. যথা. দুর্গাদাস রায় ও জমিদার রামরতন ছিলেন জ্ঞানী, সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষানুরাগী. তার সময়ে নড়াইলে শিক্ষা বিস্তার লাভ করে. জমিদার রাম রতনের সময় নলদী পরগণা ও খুলনা জেলার পরগনা দাতিয়া অন্তর্ভুক্ত হয়. এ সময়ে ইংরেজরা যশোর ও কুষটিয়ায় নীল চাষের জন্য নীল কুঠি তৈরি করে. নীল চাষ লাভজনক বলে তিনি নীল চাষের ব্যবসা শুরু করেন. তিনি অনেক নীলকুঠি তৈরি করেছিলেন এবং ইংরেজদের কাছ থেকে ক্রয় করেছিলেন. যা হল তার পারদর্শীতা. কারণ সেই প্রাচীন যুগে খালবিল নদী নালাযুকত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল. অর্থের প্রয়োজন ছিল নিজ সন্তানদের শিক্ষার জন্য। ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সুকৌশলে ১৮৫৭ সনে রাণী ভিক্টোরিয়ার নামে ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় অর্থাৎ নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট হাইস্কুল তৈরি করেন. আর তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সনে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন. তাছাড়াও নড়াইল লোহাগড়া ও কালিয়ার সকল প্রসিদ্ধ স্কুল কলেজ সবই ১৮০০ থেকে ১৯০০ শতাব্দীর প্রথমেই অর্থাৎ জমিদার আমলেই তৈরি। পরবর্তী ইতিহাসে দেখা যায়.. জমিদার রামরতনের পুত্র কালি প্রসন্ন অত্যন্ত নিষঠাবান ও ধার্মিক ছিলেন. জমিদার হরনাথ রায়ের পুত্র কিরণ চন্দ্র গভর্নর সেন্ট কর্তৃক “রায় বাহাদুর“ উপাধি লাভ করেন. ভ্রাতৃপুত্র ভবেনদ চন্দ্রও উচ্চ শিক্ষিত ও মানবতাবাদী ছিলেন। জমিদার রাধাচরণ রায়ের জৈষঠ পুত্র যতীনদর নাথ রায় ইংল্যান্ড থেকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন. অপর পুত্র যোগেনদর নাথ শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান জমিদার ছিলেন। রামরতনের মৃত্যুর পর তার মেজ ভাই রায় বাহাদুর জমিদারের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন. কথিত নড়াইল হতে যে পাকা রাস্তা যশোহর পর্যন্ত চলে গেছে তা তৈরি করার সময় তিনি নিজ অর্থ দান। এই হল আমাদের নড়াইলের জমিদারদের ইতিহাস. ইতিহাস কখনো মুছে যায় না. মাঝে মাঝে ইতিহাসকে বিকৃত করে চাপিয়ে রাখা হয় যা ক্ষনিকের জন্য. সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে তা সত্য হয়ে জেগে ওঠে। নড়াইলের ইতিহাস ঐতিহ্য হল ধর্মীয় চেতনা ও স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত. যেখানে রয়েছে দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ, মানবতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ. নড়াইল জেলার সৌভাগ্য যে, সেই প্রাচীন যুগে মদনগোপাল দত্তের মত একজন শিক্ষিত মানুষ নড়াইলে এসে বসতী স্থাপন করেছিলেন যার জন্য আজ আমরা দু লাইন লিখতে পারছি. অথচ সেই শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান, মানবতার কোন মূল্যায়ন করা হয় নি. তাদের চিন্তা চেতনাকে বিকশিত না করে তাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে. ধ্বংস করা হয়েছে সকল ইতিহাস ও ঐতিহ্য. কিন্ত পৃথিবীতে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু মানুষের চিন্তা চেতনা ও কার্যাবলী কোনদিন ধ্বংস হয় না।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)