দেশে প্রথম চালু হচ্ছে হিজড়া মাদ্রাসা
রাজধানী ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের লোহার ব্রিজ এলাকায় নির্মিত হয়েছে হিজড়াদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটির নাম রাখা হয়েছে ‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা’।
মাদ্রাসাটি শুক্রবার উদ্বোধন করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি হবে বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রথম একটি মাদ্রাসা।
সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে, এই সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
আয়োজকরা বলছেন, হিজড়া, বৃহন্নলা, কিন্নরী বা তৃতীয় লিঙ্গ- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজে এরা নানাভাবে অবহেলিত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অবাঞ্ছিত। তাই এই জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর লক্ষ্যে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এর আগে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশে আলাদা কোন মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও হিজড়াদের পড়ানোর কোন ব্যবস্থা নেই বলে জানা গেছে।
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য একেবারে একটি আলাদা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়েছেন এই কমিউনিটির সদস্যরা।
এই মাদ্রাসায় মূলত কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী শিক্ষাও দেয়া হবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন। ফলে এখান থেকে পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারিগরী পেশায় যুক্ত হতে পারবেন।
মাদ্রাসাটির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সচিব মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ হুসাইনী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে শুক্রবার এই মাদ্রাসা উদ্বোধনের কথা রয়েছে।
তিনি বলেন, উদ্বোধনের পর ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা দেড়শো’র বেশি হিজড়াকে এই মাদ্রাসায় ভর্তি করা হবে।
মি. হুসাইনী বলেন, “ঢাকার যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, কামরাঙ্গীর চর, সিলেটি বাজার – এমন কয়েকটা এলাকায় আমাদের ২০-২৫ জন করে শিক্ষার্থী আছে, যাদের আমরা আলাদা করে পড়াতাম। এই মাদ্রাসাটি উদ্বোধন করা হলে তাদের সবাইকে এখানে রেখে একসাথে পড়াতে পারবো।”
দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে একটি তিন তলা ভবনে। এর প্রতিটি তলায় প্রায় ১২০০ বর্গফুট জায়গা রয়েছে। এখানেই সব শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া এবং পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
মাদ্রাসাটির মহাসচিব মোহাম্মদ আব্দুর রহমান আজাদ বিবিসি বাংলাকে জানান, এই শিক্ষার্থীদের পড়াতে ১০জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই এই মাদ্রাসা নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়।
দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসায় পড়ার ক্ষেত্রে কোন বয়স সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি, অর্থাৎ হিজড়া জনগোষ্ঠীর যে কোন বয়সের মানুষ এই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে পারবেন।
এখানে পড়াশুনা করতে শিক্ষার্থীদের কোন খরচ গুণতে হবে না। মি. হুসাইনী জানান, মরহুম আহমদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে মাদ্রাসাটির যাবতীয় কার্যক্রম চলবে।
“কেউ তৃতীয় লিঙ্গের কি-না, তা শনাক্ত হয় মোটামোটি পরিণত বয়সে এসেই। এজন্য আমরা কোন বয়সের সীমা রাখি নাই। কেউ হিজড়া শনাক্ত হওয়ার পরই এখানে ভর্তি হতে পারেন, তিনি যে বয়সেরই হোন না কেন,” বিবিসি বাংলাকে ব্যাখ্যা করছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে হিজড়াদের ভোটাধিকার দেয়ার পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী তারা নারী বা পুরুষ নয়, বরং হিজড়া হিসেবে পরিচিতি পান। এছাড়া ভোট দেয়া, এমনকি নির্বাচনেও অংশ নিতে তাদের বাধা নেই।
কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা বৈষম্যের শিকার বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মক্তবে ছেলেমেয়েদের যৌথশিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে হিজড়াদের জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা দেখা যায় না।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য শিল্পী জানান যে তাদের কমিউনিটির অধিকাংশের অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই।
তিনি এবং তার সাথীরা বিভিন্ন বিয়ে-জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নেচে গেয়ে, অথবা কারও বাড়িতে নতুন শিশু জন্মালে বখশিশ তুলে জীবিকা চালিয়ে থাকেন।
এছাড়া হাট বাজার থেকেও তারা চাঁদা তুলে থাকেন। এ কারণে এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার অভিযোগ প্রায়ই ওঠে।
মূলত শিক্ষার অভাবেই এই বিকল্প উপায়ে আয় রোজগার করতে হয় বলে দাবি করেন শিল্পী।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “আমাদেরকে তো কেউ কাজে নিতে চায় না। কিছু পড়াশোনা থাকলে হয়তো ভালো কোথাও কাজ করতে পারতাম। পড়াশোনার ব্যবস্থাও তো নাই। এজন্যই আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেভাবে নাচ গান করে টাকা ইনকাম করতেন, আমরাও সেটাই করি।”
দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসার মহাসচিব মোহাম্মদ আব্দুর রহমান আজাদ বলছেন যে হিজড়াদের এ ধরণের পেশা থেকে বের করে এনে তাদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যেই তাদের জন্য আলাদা একটি মাদ্রাসা গড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “হিজাড়ারাও ইনসান (মানুষ), আল্লাহর সৃষ্টি। কিন্তু তাদের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা নাই, তাদেরকে কেউ মসজিদে ঢুকতে দেয় না। এ কারণে তারা বাধ্য হয়ে নৈতিক জায়গা থেকে সরে আসছে, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে মানুষকে বিরক্ত করছে। এটা তো ওদের দোষ না। এজন্য আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।”
প্রায় নয় বছর বয়স পর্যন্ত শিল্পী তার বাবা-মায়ের তত্ত্ববধানে ছিলেন। ওই বয়সে তিনি স্কুলে কিছুদূর পড়াশোনা করতে পারলেও হিজড়া কমিউনিটিতে আসার পর সেটা আর এগিয়ে নিতে পারেননি।
তার কথায়: “বাবা-মা যতোটুকু লেখাপড়া করাইসে, ততোটুকুই যা শিখসি। তারপর যখন বুঝলাম আমি হিজড়া, তারপর তো স্কুলে সবাই আমাকে ঘৃণা করতো, ভয় পেতো, ক্রিটিসাইজ (সমালোচনা) করতো। এজন্য আর লেখাপড়া হয় নাই।”
বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা অবহেলার শিকার হয়ে থাকে – এমনটা উল্লেখ করে মি. হুসেইনী বলেন, “কোন পরিবারে হিজড়া শিশু জন্ম নিলে, মা-বাবাই অনেক সময় তাকে আপন করতে চায় না। বাইরের মানুষ আর কি আপন করবে! কিন্তু ওদের তো কোন দোষ নাই।”
“আমরা চাই তারা যেন সমাজের বোঝা না হয়। তাদেরকে মানবসম্পদে পরিণত করতেই আমরা এই মাদ্রাসা করার কথা ভেবেছি। যেন তারা কুরআন শিক্ষাও পায়, আবার কারিগরী কাজ করে সম্মানের সাথে চলতে পারে।”
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি পর্যায় থেকেও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন শিল্পী।
“আমাদেরও মন চায় আরও দশ জনের মতো চলতে, সম্মান নিয়ে চলতে। আমাদেরও মন চায় নিজের পায়ে দাঁড়াইতে। যদি সুযোগ পাই তাহলে ওই পথেই যাবো।” খবর: বিবিসি বাংলা
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)