কালিগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায়ের অর্থাভাবে মৃত্যু!
মুক্তিবার্তা, ভারতীয় তালিকা ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে নাম থাকার পরও ভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় অর্থাভাবে যথাযথ চিকিৎসা নিতে না পারায় বীর মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায় (কর্মকার) এর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান।
কিডনি ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। তার বাবার নাম ভূদেব কর্মকার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দু’ ছেলে, দু’ মেয়ে, নাতি নাতনীসহ অসংখ্যা গুণগ্রাহীকে রেখে গেছেন।
শুক্রবার বিকল তিনটায় তাকে গার্ড অব অনার শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাঁশতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
কালিগঞ্জ সহকারি কমিশনার (ভূমি) মুজিবুল আলম, কালিগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান ও উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হাকিমর উপস্থিতিতে গার্ড অব অনার কার্যক্রম পরিচালনা করেন সাতক্ষীরা পুলিশ লাইনের সহকারি উপ-পরিদর্শক মহিউদ্দিন।
স্বজনরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন কিডনি ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছিলেন গোবিন্দ রায়। সর্বশেষ তিনি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ৯ জানুয়ারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার প্রাক্কালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে যেয়ে আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াশুনা করাকালিন ভাই আনন্দ, সদানন্দ, বোন সবিতা, সীতা ও আরতীর সঙ্গে বাবা ও মায়ের হাত ধরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট ময়লাখোলায় অবস্থান নেন তিনি। দেশ মাতৃকাকে শেকল থেকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহবান সাড়া দিয়ে বসিরহাট জেলখানার পাশে মুক্তিফৌজে নাম লেখান তিনি। তার সঙ্গে সাতক্ষীরার শহরের পলাশপোল, কামাননগর, রাজার বাগনসহ বিভিন্ন এলাকার তকবগে যুবকরা ছিল। একই এলাকার মুকুন্দ মধুসুধনপুরের জহর আলী মাস্টারের মাধ্যমে মুক্তিফৌজ নাম লেখোনার পরপরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসনাবাদের তকিপুর ক্যাম্পে। সেখান থেকে বিহারের চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প এক মাস ধরে তাদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে তাদেরকে আনা হয় কল্যাণী ক্যাম্প। সেখানে দু’দিন অবস্থানকালে সৌভাগ্যবশতঃ দেখা হয় কর্ণেল ওসমানি ও তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে। এরপর হাকিমপুর ক্যাম্প নিয়ে এসে প্রায় তিন সপ্তাহ রাখা হয়। এখানে ৯নং সেক্টরের আওতাধীন ভোমরা ও রমেশবাবুর আর্মি ক্যাম্পে অবস্থানকালে তাদের সঙ্গে পাকা হানাদারদের সামনাসামনি যুদ্ধ হয়। বাঁকাল ব্রিজ ও বিনেরপোতা ব্রীজ তাদের নেতৃত্ব উড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা কুলিয়া ব্রীজের পাশে একটি বাড়িতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন কিছুদিন। তারপর দু’ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রাজারবাগান সরকারি কলেজের পাশে ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে সবশেষ অস্ত্র জমা দেন। ওই সময় তাদেরকে বাড়ি ফেরার জন্য ক্যাম্প থেকে মাথাপিছু ৭৫ টাকা করে দেওয়া হয়। বাড়ি ফিরে দেখেন শুধু মাটির ভিত রয়েছে। চালা ও দেয়াল নেই। মেঝে খুঁড়ে লুকানো সম্পদের সন্ধান চালানো হয়েছে।
জীবদ্দশায় গোবিন্দ রায় বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে শহরের ইটাগাছার নিতাই দে এর মেয়ে আরতিকে বিয়ে করেন তিনি। নারায়ান, শিবপদ, মমতা ও নমিতা তাদের চার সন্তান। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও পাকিস্তানের পরাজিত শক্তি বিএনপি ও জামায়াতের ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে মুক্তিযোদ্ধার নাম মুখে আনতে পারেননি দীর্ঘদিন। একপর্যায়ে ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানকালে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খুঁজে বের করা হয়।
গোবিন্দ রায়ের স্বজনরা অভিযোগ করে জানান, তিনি একজন দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ বিভিন্ন অনুদান দিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখলেও পানিয়া গ্রামের জনৈক আব্দুর রউফের কারণে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে তার ভাতার টাকা বন্ধ কর দেন গত ৪ জানুয়ারি বদলী হওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক রাসেল। ভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় তার পরিবারের লোকজন তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র ঠিকমত কিনতে পারতো না।
গোবিন্দ রায় এর ছেলে শিবপদ রায় জানান, পারিবারিক অভাবে অনটনের কারণে কালিগঞ্জ থানার পাশে যমুনা নদীর চর ভরাটি জমিতে নির্মিত কামারশালায় বাবার সঙ্গে কাজ করছে সে। তার বাবার নভেম্বর ও ডিসেম্বরের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় তিনি ছুটেছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিমসহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। মুক্তিযোদ্ধা হাকিম বলেছেন মুক্তিবাতার্য়, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তালিকা ও গেজেট নাম থাকার পরও গোবিন্দ রায় এর ভাতা বন্ধ করার কোন কারণ নেই। তবে পানিয়ার আব্দুর রউফ পরিকল্পিতভাবে গোবিন্দ রায় এর নামে ‘গ’ তালিকায় রেখেছে। এরপর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক রাসেলের কাছে বাবার মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কিত সকল কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কাগজপত্র দেখেননি। ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার কারণে বাবার চিকিৎসা ব্যহত হচ্ছে জানালেও তিনি কোন ভ্রক্ষেপ করেনননি। কালিগঞ্জের অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলেছেন অথচ তার বাবার ভাতা বন্ধ করা হয়েছে।
ভাতা চলমান থাকলে বাবাকে আরো কিছু দিন বাঁচানো যেতো বলে আক্ষেপ করে বলে শিবপদ রায়।
মুক্তিবার্তায় নাম থাকা ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর নির্দেশনা থাকার পরেও তার বাবার ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)